Golpo/Adda

Go Back
অপরাধের গল্প

লন্ডন হোয়াইটচ্যাপেল, নগরীর একটি ছোট অংশ যেখানে বাস করে শহরের সব থেকে সুবিধা বঞ্চিত ও গরীব মানুষেরা। পুরুষেরা সাধারনত দিনে কুলি, দিন মজুর, জুতা পালিশ, এবং রাতে নানা রকম খারাপ কাজ করে থাকে, আর মেয়েরা সন্ধার পরে নামে দেহ ব্যবস্যা এবং আরো কোন নিচ কাজে। সাল ১৮৮৮ জুন মাসের এক সন্ধায় হোয়াইটচ্যাপেলের ছোট একটি চার্চে মধ্যে বয়স্ক ফাদার এন্ডারসন চার্চ বন্ধের প্রস্তুতি গ্রহন করছেন। তার সারাটা যৌবন সে কাটিয়েছেন এই চার্চে এসব মানুষের মাঝে ঈশ্বর ভীতি ও এদের সৎ কাজের প্রতি আকৃষ্ট করার ব্যর্থ চেষ্টায়। যদিও সে সফল হয়নি কিন্তু আজো সে হাল ছাড়েনি। চার্চে অল্প আলো যা চার্চটিকে আলো আধারীর একটি ছোট কুঠুরি করে রেখেছে। তার প্রায় সব কাজ শেষ হয়ে এসেছিল কিন্তু এমন সময় কারো পায়ের আওয়াজে সে ঘুরে দাড়ালো। তার চোখ পড়ল একজন মানুষের দিকে যে আবছা আলোতে চার্চের প্রবেশ পথে দাড়িয়ে আছে। ফাদার এমন সময় লোকটির আগমনে বিরক্ত হলেও তা আড়াল করে মধুর একটি হাসি দিয়ে লোকটির দিকে তাকালো। আমি মনে হয় আপনাকে বিরক্ত করলাম? আমতা আমতা করে লোকটি বললো। না কোন সমস্যা নেই, ভেতরে আসুন। ফাদারের কথায় কিছুটা সহজ হয়ে লোকটি এগিয়ে এলো। ফাদারের কেন যেন মনে হলো লোকটি এমন ভাবে আসছে যাতে তার চেহারাটা ছায়াতে ঢাকা পড়ে, নাকি ছায়াগুলি এমন ভাবে তার মুখের উপর পড়ছে যাতে তার চেহারা দেখা না যায়? সে যাই হোক লোকটি কাছে এলেও তার লম্বা হ্যাট এর জন্য তার চেহারার বিশাল একটি অংশ ঢাকা পড়ে আছে। পরনে ময়লা কিন্তু ভদ্্র পোষাক, কালো লংকোটের নিচে পুরোনো শার্ট হলেও তা যে যথেষ্ঠ দামি তা এখনো বোঝা যায়, লংকোটটি ঠিক কালো বলা যায় না, তবে এক সময় কালো ছিল এতটুকু বলা যায়। মাথায় লংকোট এর সাথে সাদৃশ্য রেখে একটি লম্বা হ্যাট, যা ফাদারকে ”এলিস ইন উয়ান্ডার ল্যান্ডের” ম্যাড হ্যাটারের হ্যাটের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। হ্যাটের রং এর ও কোট এর মত অবস্থা । হ্যাটের নিচে কাধ পর্যন্ত লম্বা চুল, চোখ দুটি দেখা যায় না কালো গোল কাচের চশমার জন্য। ফাদারের কাছে লোকটিকে দেখে কেন জানি একজন অভাবী ভদ্রলোক মনে হলো। গলায় যথা সম্ভব ভদ্রতা, ও কোমলতা বজায়ে রেখে ফাদার বললেন, বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি। এমন একটি সহজ প্রশ্ন শুনে লোকটিকে মনে হলো যেন খুব বড় অসুবিধায় পড়ে গেলেন, কিছুক্ষন চিন্তা ভাবনা করে যেন জবাব দিলেন। তেমন কিছু না, আমাকে শুধু সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দেবেন। ফাদার কোমল ভাবে হেসে বললেন, আমিতো সে জন্যই এখানে আছি। বলুন কোন ব্যাপারে রাস্তা চান? লোকটি খুব ব্যাকুলতার সাথে বলে উঠল। আপনাকে তাহলে সব শুনতে হবে, অনেক সময়ের ব্যাপার, এত সময় কি আপনার হবে? আমি অবিবাহিত আমার ঘরে ফেরার তাড়া নেই, ফাদারের জবাব। ও তাহলে আমি শুরু করি। আমার নাম জোন্স হপকিন্স, জন্ম সার্সেক্্র এ। বাবা মার আদরের জোন্স, তাদের একমাত্র সন্তান। আমার বাবা একজন কৃষক ছিলেন। সেখানকার জমিদারের জমিতে চাষ করতেন, যা ফলত তার অর্ধেক জমিদার ও অর্ধেক আমাদের থাকত। আমি যখন খুব ছোট আমার বাবা আমাকে বলতেন, তুমি আমার মত কারো পায়ের নিচে কাজ করবে না, তুমি অনেক বড় হবে, অনেক বড়। ছোট বেলা থেকে কথাটা আমার মাথায় গেথে যায়, গ্রামের পাঠশালায় যা শিখাতো তা মনোযোগ সহকারে শিখতাম, আর ভাবতাম আমি অনেক বড় হব, অনেক বড়। যখন আমি কিশোর বয়সে এলাম তখন পৃথিবীর চরম সত্যটা বুঝতে পারলাম। তা হলো, বড় হবার স্বপ্ন আমাদের মতো মধ্যেবৃত্ত ও নি¤œবৃত্ত ঘরের ছেলেদের দেখতে নেই। কিন্তু কেন জানি আমার বাবা এ ব্যাপারে হাল ছাড়লেন না। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছিল, এমন সময় আমাদের এলাকায় দেখা দেয় প্লেগ এর প্রকোপ, অনেক মানুষ তাতে মারা যায়। আমাদের পরিবারের প্রথম আক্রান্ত হলো আমার মা, তার কিছুদিন পর আমার বাবা। আমি বেচে যায়। আমার বাবা মারা যাবার সময়ও আমায় বলে যান, কিছুই তোকে দিতে পারলাম না, শুধু দোয়া করি তুই যেন অনেক বড় হস। আমিও তাকে কথা দিলাম আমি অনেক বড় হবো, এতো বড় হব যে আমাকে ইতিহাস অমর করে রাখবে। তাদের মৃত্যুর পর আমি সবকিছু বেচে দেবার চিন্তা ভাবনা করছিলাম এমন সময় আমাদের জমিদার বলে উঠল, সব বেচবি মানে, তোর বাবা আমার কাছে এগুলো অনেক আগে বন্ধক রেখেছিল, এগুলো আমার। সেই সময় আমি নিজে নিজে আরো একটি বিষয় বুঝতে পেরেছিলাম তা হলো, যাদের টাকা আছে তাদের সাথে লাগতে নেই। তাই বিনা বাক্য সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আমি পাড়ি জমালাম লন্ডন। এতো বড় শহর আমার নিশ্চয় কোন না কোন গতি হবেই। হলোও তাই প্রথমে কুলির কাজ শুরু করলাম, এরপর বিভিন্ন রকম অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়লাম, দিনে দিনে খারাপ ভালো নানা রকম লোকজনের সাথে আমার পরিচয় হতে লাগল, বাড়তে লাগলো আমার জগৎ। অনেক চেষ্টা করে শহরের একটি লাশকাটা ঘরে চাকরি জুটিয়ে নিলাম, সেখানে লাশগুলো কাটা ছেড়া করতে প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে আর কিছু মনে হতো না। এদিকে একটি ভালা কাজ পেয়ে আমি আমার খারাপ কাজের সাথীদের সাথে যোগাযোগ বন্ধকরে সৎ ভাবে কাজ করতে লাগলাম। এমন সময় একজন ডাক্তার আমার লাশের কাটা ছেড়া দেখে আমার সাথে দেখা করলেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন যে আমার হাতের কাজ খুব নিখুত, আমি যদি চায় তাহলে তিনি অস্ত্রোপাচারের কাজের সহোযোগী হিসেবে আমাকে নিতে চান। এমন সুযোগ বারবার আসে না, আমিও রাজি। এরপর থেকে আমি আজ চার বছর তার সহোযোগী হিসেবে কাজ করছি। এই আমার ঘটনা। ফাদার বললেন কিস্তু আপনার আমাকে প্রয়োজন কেন? আপনিতো রাস্তা পেয়েই গেছেন আমি কি দেখাবো? লোকটি এবার বললো, আমি আমার বাবাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তার জন্য মনে মনে কষ্ট অনুভব করি। এ কষ্ট থেকে মুক্তির পথ একমাত্র আপনিই দিতে পারেন। ফাদার হেসে বললেন, ”দেখুন আমাদের জীবন ক্ষনস্থায়ী, কিন্তু এই ক্ষনস্থায়ী জীবনে আমরা অনেক কিছু পেতে চাই, অনেক কিছুই করতে চাই, কিন্তু সবার পক্ষে তা সম্ভব হয়না। অনেকে বড় হবার জন্য ভালো পথ বেছে নেয় অনেকে বা খারাপ পথ কিন্তু দুজনের রাস্তা একই। কখনো দেখবেন কেউ ভালো ভাবে সৎ ভাবে বড় হয়ে উঠে, আবার কখেনো সে শুধু বড় হবার চেষ্ঠায় চালিয়ে যায় আর বড় হয়ে উঠা হয় না, কিন্তু তার পাশ দিয়ে খারাপ কাজ করে অন্য একজন বড় হয়। বড় হবা বা মানুষের মনে ঠায় পাওয়ার দুটি রাস্তা সেগুলো ভাল কাজের দ্বারা এবং খারাপ কাজের দ্বারা। ভাল ভাবে কোন কিছু পেতে অনেক সময় লাগে, অনেক ধয্য ধরা লাগে, সঠিক পথ বেছে কাজ করা লাগে। আমার মনে হয় আপনি সেই পথের দেখা পেয়ে গেছেন, মনোযোগ দিয়ে আপনার কাজ করুন এবং অপেক্ষা করুন, নিশ্চয় আপনি আপনার বাবাকে দেয়া কথা রাখতে পারবেন। আমি আপনার জন্য প্রার্থনা করব।” লোকটি ঘুরে বললো শুধুমাত্র এইটুকু আশ্বাস পাবার জন্যই আপনার কাছে আশা ফাদার। ভালো থাকুন, আপনার সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত। ধীর পদক্ষেপে সে চার্চের বাইরে এল। বেশ রাত হয়ে গেছে, বাইরে লন্ডনের সেই বিখ্যাত কুয়াশা, আশেপাশে একদম নির্জন, শান্ত মনে জোন্স সবকিছু দেখছে। আসলেই মানুষের মনে ঠায় পাবার দুটি রাস্তা একটি ভালো আর একটি খারাপ রাস্তা, জোন্স ঠিক করে ফেলেছে এরপর সে কি করবে, ইতিহাসের পাতায় তাকে অমর হতেই হবে। ধীর পায়ে সে কুয়াশার ভেতরে হারিয়ে গেল। এরপর?? এরপর সবই ইতিহাস।। ১৮৮৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পাচটি খুন হয় হোয়াইটচ্যাপেল এ। নিহতরা সকলে মহিলা, সাধারনত পেশাদার যৌনকর্মী। প্রথম মরদেহ পাওয়া যায় বাকস রো (বর্তমান ডুরওয়াড স্ট্রিট, হোয়াইটচ্যাপেল) ৩১ আগস্ট ভোর ৩.৪০ মিনিটে, শুক্রবার। নিহতের নাম মেরী অ্যান নিকোলস। মৃত্যুর কারন গলায় নিখুত ভাবে দুটি আঘাত যা কোন ধারালো অস্ত্র দিয়ে করা হয়েছে। তার পেট ঐ একই অস্ত্র দ্বারা ফেড়ে ফেলা হয়েছিল। দ্বীতিয় মরদেহ পাওয়া যায় অ্যানি চ্যাপম্যানের, ৮ সেপ্টেম্বর, শনিবার সকাল ৬.০০টার সময়, ২৯ হ্যানব্যারি স্ট্রিট এর কাছে একটি দরজার সামনে। নিকোলস এর মত এর ও মৃত্যুর কারন গলায় ধারালো অস্ত্রের দ্বার নিখুত দুটি আঘাত, এবং পেট ফাড়া অবস্থায় পাওয়া যায়। পরবর্তীতে জানা যায় তার মুত্রথলীর একটি অংশ দেহ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। চ্যাপম্যানকে শেষ দেখা যায় ভোর ৫.০০টায় একজন লম্বা হ্যাট পরিহিত বড় চুলের একজন লোকের সাথে। তৃতীয় ও চতুর্থ শিকার ছিল এলিজাবেথ স্ট্যাইড ও ক্যাথরিন ইডওস। তারা খুন হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। স্ট্যাইড এর মরদেহ পাওয়া যায় রাত ১টায় ড্যাডফিল্ড ইর্য়াড। গলায় শুধুমাত্র একটি আঘাতের চিহ্ন ও পেটে ক্ষত খুব অল্প যেন কেউ পেট চিরতে গিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেছে। এই খুনের সময় ধারনা করা হয় খুনি কনো কারনে বাধাগ্রস্থ হওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি কাজ করতে গিয়ে পরে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর ঠিক তিন ব্লক পরে একঘন্টার ব্যাবধানে পাওয়া যায় ইডওস এর লাশ। মৃত্যুর কারন গলায় দুটি নিখুত ক্ষত, পেট হা করে ফাড়া ও কিডনি সহ অনেক কিছুর অনুপস্থিতি। পঞ্চম শিকার মেরী জেন কেলী যার লাশ পাওয়া যায় ৯ নভেম্বর, শুক্রবার সকাল ১০.৪৫ মিনিটে তার নিজের বাড়িতে। মৃত্যুর কারন গলায় নিখুত ুদটি আঘাত ধারালো অস্ত্রর, পেট ফেড়ে রাখা হয়েছিল এবং হার্ট, কিডনি সহ প্রায় অধিকাংশ অংশ অনুপস্থিত ছিল। কে কেনই বা এই খুনগুলো করেছিল কেউ বলতে পারে না। পরবর্তীতে স্কটল্যান্ড ইর্য়াড প্রধান এই খুনের দায় শিকার করে একটি চিঠি পান যেখানে খুনি নিজেকে জ্যাক দ্যা রিপার নামে পরিচয় দিয়েছিল। কিন্তু আমরা জানি জোন্স ইতিহাসের পাতায় অমর হবার জন্যই এই খুন গুলো করেছিল। হয়ত বা সে নিজের নামে পরিচিতি পায়নি তাতে কি? জ্যাক নামে তো অমর হয়ে আছে, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ খুনী হিসেবে।।