ভূতের বাড়ি বা হন্টেড হাউজের সংখ্যা পৃথিবীতে নেহায়েত কম নয়। আমার ধারণা, সভ্য পৃথিবী যেভাবে ভূত-প্রেতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে চলে, সেখানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এতো এতো ভূতের বাড়ির অস্তিত্ব কিছুটা অবাক করার মতোই বটে। তবে বাস্তব কিছুটা ভিন্ন। হন্টেড হাউজ বা ভূতের বাড়ি কখনো কখনো লোককথায় গড়ে ওঠে, কখনো বা বাস্তবেই কোনো না কোনোকিছু অস্বাভাবিক থাকে। তবে তা কতখানি সত্য, তাও কেন যেন শক্ত দলিল-প্রমাণ দিয়ে দেখা যায় না। আজকে একটা ভূতের বাড়ির কথা বলবো। মজার ব্যাপার হলো, ভূতের বাড়িটা স্থানীয়ভাবে বেশ নামকরা। আগে অনেককেই ভূতের বাড়ি ভূতের বাড়ি বলে ডাকতে শুনতাম। তবে এখন বিল্ডিংটাকে হাজীর বিল্ডিং নামেই বেশি শোনা যায়। বিল্ডিংটার মালিক এক হাজী সাহেব। তার আসল নাম কী জানি না। আসলে জানার চেষ্টাও করিনি। এটি কোনো অনুসন্ধানীমূলক পোস্ট নয়। এটি কেবল লোকমুখে যেসব কথা প্রচলিত আছে সেসব নিয়েই একটি ‘জানানোমূলক পোস্ট’। তো আমাদের আজকের এই ভূতের বাড়ির অবস্থান ঢাকার ব্যস্ততম (এবং ধূলাবালি এবং মার্কেটের দিক দিয়ে মোটামুটি শীর্ষস্থানে থাকা) এলাকা মিরপুর এক নম্বর। মিরপুর মাজার রোডের বুদ্ধিজীবি শহীদ মিনারের খানিকটা উত্তরে এই ভূতের বাড়ির অবস্থান। এই ভূতের বাড়ির ইতিহাস কিছুটা বোরিং টাইপের। কিন্তু যথেষ্ট ইন্টারেস্টিংও। আমি ছোটবেলা থেকে এই বাড়িটি একদম খালি দেখে আসছি। তখন অবশ্য বাড়ির চেহারা এখনকার মতো রঙিন ছিল না। খসে পড়া চূনের রঙে ভর্তি ছিল পুরোটা বিল্ডিং। কাঁচগুলো সেই শুরু থেকেই একইভাবে ভাঙ্গা। জীবনে কাউকে এই বাড়ির দোতলা বা তিনতলায় উঠতে দেখিনি। জনমানুষের ছায়াও নেই এই বাড়িটিতে। এতো ব্যস্ততম রাস্তার ধারে এই বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরটা যেন সেই কলিযুগ থেকেই খালি। তবে একেবারে খালি বলার উপায় নেই। বাড়ির নিচতলায় দোকান রয়েছে। আমি ছোট থাকতে আম্মু নাকি মাঝে মাঝে হাজির বিল্ডিং-এর নিচ থেকে দুধ কিনে আনতো। তখন দুধ বিক্রি হতো। বছর দুই-এক আগে দেখলাম থাই-এর দোকান দিয়েছে। কিন্তু দোকানটা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ ব্যবসা বেশ ভালোই যাচ্ছিল দেখা গেছে। তারপরও কেন দোকান বন্ধ হয়ে গেল, এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার যেন কেউ নেই। অদ্ভূত এই বাড়ি। এই বাড়ির নিচে যতদিন দোকান ছিল ততদিনই বাড়িটিতে মানুষের আনাগোনা ছিল। কিন্তু বাকি সময়টা এই বাড়ি নিরব-নিস্তব্ধ। এখন সারাদিনই এক অবস্থা। বছরের পর বছর ধরে এই বাড়িতে কেউ রাত কাটায় না। রাত কাটানোর অযোগ্য একটি বাড়ি এটি, লোকমুখে এমনটাই শোনা যায়। বাইরে অনেক বাতাস। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক ঠাণ্ডা। গ্রীষ্মের এই অত্যধিক ঠাণ্ডা বাতাসের দু’টো অর্থ হতে পারে। এক, ঝড়-বৃষ্টি আসছে, অথবা দুই, ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেছে। আজকের ক্ষেত্রে বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই বাইরে অনেক ঠাণ্ডা বাতাস। ড্রয়িংরুমের পর্দাটা থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে। আকাশে ছোট্ট একটা চাঁদ। ফ্যাকাসে রঙের চাঁদটার পাশ কেটে যাচ্ছে অসংখ্য খণ্ড খণ্ড মেঘ। ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বসে এসব দেখা যায় না। এই দৃশ্য চোখে পড়লো যখন রাত ১১.৪৫ মিনিটে বাড়ির মেইন গেইট লাগানোর জন্য বের হলাম। বাসার চারপাশে সব বিল্ডিং। এসবের মাঝেও প্রকৃতির অশুভ ও অপূর্ব এই দৃশ্য চোখে পড়া যেন ভাগ্যেরই ব্যাপার। গেইটটা খোলা ছিল। আমাদের বাসা দক্ষিণমুখী। আর বাসার সামনেই গলির রাস্তা। তাই খোলা জায়গা দিয়ে গেইটে প্রচুর বাতাস আসে। সেই বাতাসে গেইট যেন আপনা-আপনিই নড়ে উঠছিল। গেইট লাগানোর ঠিক পূর্ব-মূহুর্তে চোখে পড়লো আজকের পোস্টের মূল বিষয়, হাজীর বিল্ডিং। আগেই বলেছি, লোকমুখে শোনা যায় এই বাড়িতে কেউ রাতে থাকতে পারে না। স্পষ্ট কারণ কারো কাছেই জানা না গেলেও সবাই এতটুকুই জানে যে এই বাড়িতে রাতে থাকা সম্ভব নয়। তবে সম্ভব নয় বলে সবাই কিন্তু দমে যায়নি। নিতান্ত জোর করেই বেশ কয়েকবার মানুষ থাকতে চেয়েছিল এই বাড়িতে। কিন্তু তারা কেউই দু’রাত টিকতে পারেনি। প্রথম ঘটনাটা ১৯৮৮ সালের। আমার জন্মের আগের ঘটনা। আম্মুর মুখে শোনা ঘটনা। তখন মিরপুরে প্রবল বন্যা। আমাদের বাসায়ও হাঁটু পানি। তার উপর ছিল সাপের অত্যাচার। তাই বাসাবাড়ি ছেড়েই দূরে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। বলা বাহুল্য, এতো বছর আগে মিরপুরের মাজার রোডে তেমন কোনো দালানকোঠা ছিল না। তবে হাজীর বিল্ডিং তখন ঠিকই ছিল। তিন তলা বলে অনেকেই এতে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বরাবরের মতোই বাধা দেন বাড়ির মালিক। কিন্তু বাধা না মেনেই একরকম জোর করে কিছু মানুষ বাড়ির দোতলায় উঠেছিল। বন্যায় মানুষের জীবন যায়! আর সে আছে তার বাড়িতে থাকতে দিবে না এই তালে! তখন নিতান্ত মানবিকতার খাতিরেই হোক বা চাপাচাপিতেই হোক, থাকতে দিতে রাজী হয় মালিক। কিন্তু সেবার কেউই থাকতে পারেনি। পরদিনই জিনিসপত্র গুছিয়ে এলাকা ছাড়ে জোর করে থাকতে চাওয়া সেসব মানুষগুলো। কারণ স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও এইটুকু জানা গেছে যে, রাতে অদ্ভূত সব শব্দ হয় এবং একটি সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বাড়িময়। ভয় পেয়ে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমানোর চেষ্টাও সফল হয়নি। মাঝরাতে বিকট শব্দে ফেটে গিয়েছে বৈদ্যুতিক বাল্বের কাঁচ….।