কেডা! কেডা তুমি!!?
- আমি গুলে জান্নাত।
বলেই মেয়েটা হেসে ফেলল। মিহি মসৃণ কাপড়ের নীল একটা জামা পড়া। লাউয়ের ডগার মত সরু হাত। হাতের আঙ্গুল যেন সৌখিন কলম। ঘন কালো চুলগুলো কোমড়ের নিচতক নেমে গেছে। গায়ের রঙ দুধে-আলতা কাঁচা-সোনা। ঠিকরে ঠিকরে আলো-আভা বেরুচ্ছে সারা গা থেকে।
- আমি কি খোয়াব দেখতাছি? না মইরা গেছি?... বেহেস্ত নি এইডা?
- না। তুমি জেগে আছ এবং বেঁচেই আছ।
মেয়েটা আবারো হাসতে থাকে। রুস্তম গাঁয়ের সবচে' সাহসী পুরুষ। সাহসী না হলে পদ্মার পাড়ের চরে টেকা যায় না। এখানে বাপ-দাদার দেয়া জমি নিজ দখলে রাখতে প্রতিমুহূর্তে লড়তে হয়।
আছে সর্বনাশী পদ্মা, যখন তখন ফুঁসে উঠে। আবার ধরের লক্ষ্মী বধূ। এই নারী বড়ই মায়াবী। বড় অদ্ভুত আর নিষ্ঠুর। এর রূপ যেমনি মানুষকে কবি বানায়, তেমনি নিঃস্ব-রিক্ত করেও ছাড়ে।
রুস্তম বুক আগলে ধরে রাখে নিজের পৈতিক ভিটা। উজান স্রোত থেকে মানুষ তুলে আনে। রক্ষা করে ফসল। সুদী মহাজনের টাকা পাই পাই শোধ করে। পারলে আরেক গরীবকেও বাঁচায়।
কখনো ক্ষমতাশালীরা জোর করে পৈতিক সম্পত্তি কেড়ে নিতে চায়। তখনো সোচ্চার এই রুস্তম। গ্রামের লাঠিয়ান-পালোয়ান সে। একবার এক চর দখলের মারামারিতে একাই লড়ল গোটা তিরিশেক লাঠিয়ালের বিপক্ষে।
তার রাত-বেরাত নেই। কেউ মরলে, কারো অসুখে করলে গ্রামের সকল ধর্মের, সকল শ্রেণীর মানুষের একান্ত আস্থাভাজন ও আপন এই রুস্তম। সে তো ভয় পাবার মানুষ নয়।
- কইলা না, কেডা
তুমি?
- বললাম তো- আমি গুলে জান্নাত। কেউ কেউ অবশ্য নীলাম্বরী ডাকে।
- থাক কই?
- গুল মহল, কাসকাহান।
- জীবনে এমন জায়গার নাম হুনছি বইল্যা মনে অয় না... (নিজের ঠোট কামড়িয়ে, মাথা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বলতে বলতে ভাবে।)
- এটা পৃথিবীতে নয়, উত্তর পূর্ব আসমানের এক নগরী। আমি ঐ নগরীর রাজকুমারী।
- তুমি কি পরী?
- হুম। তুমিই না দেখতে চেয়েছিলে...
- বিশ্বাস করবার পারতাছি না।
- বিশ্বাস করা লাগবে না। বাঁশি বাজাও।
রুস্তম ভেবে পায় না- কী করবে। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না। শেষে পরীটার হাতের ইশারায় বাঁশিতে সুর তুলে,
"কি যাদু করিলা,
পীরিতি শিখাইলা,
ঘরেতে থাকিতে পারি না...."
বর্ষার মেঘলা আকাশ। হালকা বাতাস। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। হিজল তলায় দু'জন সুরের খেলায় ব্যস্ত। এমনি করে ভোর হবে হবে।
পরীটা বলল,
- আজ আসি।
- কাইল'কা আইবা তো।
- অনেক বাঁধা যে... আব্বাহুজুর বের হতে দেন না।
- তাইলে?
- এই মাদুলীটা রাখ। যখন আমাকে মনে পড়বে এর সাথে কথা বলো, আমার হয়ে উত্তর দেবে।
পরীটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। রুস্তম রওনা দিল বাড়ির পথে।
.............................................. (চলবে) সপ্তাহ দুই চলে গেল। রুস্তম সেই হিজল গাছের তলে বাঁশি বাজায়, পরীর দেখা নেই। আর সহ্য হল না। মাদুলীটা বাঁশিতে বেঁধে সুর তুলল...
"আমার মনও না চায়,
এ ঘর বাঁধিল কিশোরী।
প্রাণও না চায়,
এ ঘর বাঁধিল কিশোরী।
চল না হই উদাসী...."
- এমন পাগলামী করলে হয়?
- (রুস্তম নিজেকে সামলে নিয়ে...) যেই চান্দের অপেক্ষায় জীবনডা আমার আমাবস্যায় হারাইতাছিল, হেই জীবনডা অহন পূর্ণিমায় ভইরা গেল।
রুস্তমের চোখ থেকে ঝরে পড়া তপ্ত ভালবাসার পানি গুল নিজ হাতে মুছে দিতে লাগল। রুস্তম ওর হাত বুকে টেনে বলল,
- এইডা কি হাত নাকি মখমল কাপড়ের তুলা?
শুনে পরীটা খিলখিল করে হাসে। পরীটার চোখের রূপালী স্রোত বংশী বাদক নিজ হাতে মুছে দিল, বাহু বন্ধনে আক্রে ধরল তাকে। পরীটা ওমনি