অজানা রহস্যে ঘেরা এই আমাজন অরণ্য। ৭০ লাখ বর্গ কিলোমিটার অববাহিকা পরিবেষ্টিত এই অরণ্যের প্রায় ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার এলাকাটি মূলত আর্দ্র জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত। আমাজন অরণ্য আমাজন নদীর অববাহিকায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিরক্ষীয় বন, যা দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তরভাগের ৯টি দেশের অন্তর্ভুক্ত। অ্যামাজন রেনফরেস্ট আমাজন অরণ্য ৬০ ভাগ ব্রাজিলে, ১৩ ভাগ পেরুতে এবং বাকি অংশ কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফ্রেঞ্চ গায়ানাতে। আমাজন অরণ্যের গুরুত্ব অনেক। আমাজন বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চার্যের একটি। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মোট আয়তনের ৪০% এই বনের দখলে। আমাজন বন অত্যন্ত দুর্গম। তবে দক্ষ গাইড সহ নদীপথে ভ্রমন এই নিরক্ষীয় বনের প্রাকৃতিক বিস্ময় দেখার সবচেয়ে ভাল উপায়। ফ্রান্সিসকো দে ওরেলানা, স্প্যানিশ এই পর্যটক প্রথম মানব, যিনি আমাজন নদী ধরে পৌঁছে যান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্ট আমাজনে। যার আয়তন ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার। এই বনের বুক চিরে বয়ে গেছে আমাজন নদী। যে নদী প্রতি সেকেন্ডে ৪.২ মিলিয়ন ঘন ফুট পানি নিয়ে ফেলে সাগরে। গোটা পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদন করে আমাজন। যে কারণে আমাজনকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। ফ্রান্সিসকো দে ওরেলানা ছোট পোকা-মাকড় আর রং-বেরঙের পাখিতে সমৃদ্ধ এই বনের প্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য গবেষকদেরও বিস্মিত করে। প্রায় ৪০০-এর বেশি আদিবাসীর বসবাস এই বনে। যাদের বেশির ভাগেরই আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এখনো আমাজনের বহু গহীন স্থানে মানুষের পা পড়েনি। সোনার শহরের খোঁজে শত শত বছর ধরে এই বনেই ছুটে এসেছেন অভিযাত্রীরা। নানা রহস্য আর রোমাঞ্চ আমাজনের আসল সৌন্দর্য্য। পাখি গোপন, লুকানো ও নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের বাড়তি কৌতূহল রয়েছে। সেই কৌতূহল থেকেই মানুষ অভিযান করে, গবেষকরা খুঁজে বেড়ান রহস্যময়তার পেছনের রহস্য। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন আমাজন তেমনই এক রহস্য। পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে সবুজে আচ্ছন্ন সবচেয়ে বড় ভাগটি আমাজনের। গরম আবহাওয়াচ্ছন্ন এই রেইন ফরেস্ট মোট নয়টি দেশজুড়ে বিস্তৃত। রেইন ফরেস্ট আমাজনে মাত্র দুটি ঋতু রয়েছে। গ্রীষ্ম ও বর্ষা। গরম প্রধান এই বনে ছয় মাস গ্রীষ্ম ও ৬ মাস বর্ষা থাকে। এই বনে গুমোট গরম আবহাওয়া কখনোই সরে যায় না। প্রায় সব সময় ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা থাকায় এই বনে পথ চলা খুবই কষ্টের। এছাড়া এখানকার আর্দ্রতা থাকে ৭৭ থেকে ৮৮ শতাংশ। যে কারণে অল্পতেই হাঁপিয়ে যান বনে প্রবেশকারীরা। আমাজনে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয় এমনটি ভাবলে ভুল হবে। বরং রেইন ফরেস্ট বলা হয় এখানকার অত্যধিক আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত (বর্ষা মৌসুমে) এবং গরম আবহাওয়ার কারণে। গরম আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতার কারণে এ বনে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বৈচিত্র্যময় সমাহার ঘটেছে। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ইকো সিস্টেম সমৃদ্ধ আমাজনের বয়স কম করে হলেও ৩ হাজার বছর। এখানে আছে ১২০ ফুট উঁচু গাছ, ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ২৫ লাখ প্রজাতির কীট-পতঙ্গ, ১ হাজার ২৯৪ প্রজাতির পাখি, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ হাজারো প্রজাতির অজানা জীব-অণুজীব। গবেষকরা শুধু আমাজনের ব্রাজিল অংশেই ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৪৩টি অমেরুদণ্ডী প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন। আমাজনের প্রাণী-বৈচিত্র্যের ছোট একটি উদাহরণ পেলেই চমকে উঠতে হয় আমাজনে পেরুর অংশের একটি গাছে ৪৩ হাজার প্রজাতির পিঁপড়ার সন্ধান মিলেছে। সমগ্র ব্রিটেনেও এত প্রজাতির পিঁপড়ার দেখা পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে যত পথ্য আমরা জানি, তার প্রায় ৩৭ শতাংশ আসে আমাজনের বৃক্ষরাজি থেকে। এখানকার প্রাণী-বৈচিত্র্য অতুলনীয়। এ বনের স্তন্যপায়ীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাগুয়ার, গোলাপি ডলফিন (একমাত্র প্রজাতির ডলফিন, যা স্বাদু পানিতে বাস করে), তামানডুয়া, তাপির, মানাতি, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, বাদুড় ইত্যাদি। পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঈগল, টুকান, হোয়াটজিন, দ্রুতগামী হামিং বার্ড এবং আরও রং-বেরঙের অনেক পাখি। পৃথিবীর সব পাখির এক-পঞ্চমাংশ এ বনের অধিবাসী। মাছের মধ্যে আছে মাংসাশী লাল পিরানহা, বিপজ্জনক বৈদ্যুতিক মাছ এবং স্বাদু পানির অন্যতম বড় মাছ-পিরারুকু, যার ওজন ১৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। উভচর প্রাণীর মধ্যে বিস্ময় জাগাবে লাল চোখের গেছো ব্যাঙ। আছে পয়জন ফ্রগ। রঙিন এই ব্যাঙের ছোঁয়াতেই বিষক্রিয়ায় জীবন হারাতে পারে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। তা ছাড়া রয়েছে কুমির, অ্যালিগেটর, কচ্ছপ প্রভৃতি। মিথ নয় সত্যি! সোনার সন্ধানে স্প্যানিস কিছু মানুষ আমাজনে প্রবেশ করেছিলেন। তাদের বেশির ভাগই আর ফিরে আসেননি। যে কজন জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছেন তারা বলেছেন, ঐ বনে বিষাক্ত পানি আছে। আছে মানুষখেকো সাপ। আর আছে ফুটন্ত নদী, যার পানি নিচ থেকে টগবগিয়ে ফুটছে। আমাজনের ফুটন্ত নদী সে মিথ এবার বাস্তব হলো। আমাজন বনে সত্যিই রয়েছে ফুটন্ত নদী। এই রহস্যময় নদীর পানির তাপমাত্রা ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পানি এত গরম যে তাতে মানুষ মারা যেতে পারে। আমাজনের অ্যানাকোন্ডা নিয়েও নানা রকমের মিথ রয়েছে। মানুষ গিলে ফেলা সাপের কথা উঠলেই দৈত্যাকার অ্যানাকোন্ডার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল ওঠে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে এই দৈত্যাকার সাপ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকারের এই সাপ আমাজনের আতঙ্ক বলেই জানেন সাধারণ মানুষ। আমাজনের গ্রিন অ্যানাকোন্ডার ওজন প্রায় ১৫০ থেকে ২২৭ কেজি। লম্বায় ২৭ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। শীতল রক্তবিশিষ্ট এই প্রাণীটি রাতে শিকারে বের হয়। এই দৈত্যাকার অ্যানাকোন্ডার বিষ নেই। এ ছাড়া আমাজনে রয়েছে ব্ল্যাক কেইম্যান কুমির। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কুমির এটি। দৈর্ঘ্যে ৯ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা ব্ল্যাক কেইম্যানের ওজন হতে পারে প্রায় ৪০০ কেজি। আমাজন নদীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ গোলাপি ডলফিন। গোলাপি রঙের ডলফিন মিঠাপানির সবচেয়ে বড় সাইজের ডলফিন। প্রায় সাড়ে আট থেকে সাড়ে নয় ফুট লম্বা এই গোলাপি ডলফিন। এদের মস্তিষ্কের আয়তন মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে শতকরা ৪০ ভাগ বেশি বলে গবেষকদের কাছে গোলাপি ডলফিনের আলাদা গুরুত্ব আছে। গোলাপি ডলফিন আমাজনের অন্যতম প্রাণী হলো পিরানহা। আকারে ছোটখাটো হলেও মাংসাশী পিরানহা খুবই হিংস্র। একঝাঁক পিরানহা যখন একসঙ্গে নদীতে সাঁতরে চলে, তখন তাদের ধারালো দাঁত যে কোনো সাইজের প্রাণীদের মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে। পিরানহা মাছের চোয়াল এবং দাঁত এতটাই শক্ত এবং ধারালো যে আমাজনের আদিবাসীরা এদের দাঁত দিয়ে হাতিয়ার তৈরি করে। মাত্র ১৮ ইঞ্চি লম্বা পিরানহার প্রায় ৬০ রকমের প্রজাতি শুধু আমাজন নদীতেই দেখা যায়। পিরানহা আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থান, ক্রমাগত বিরূপভাবে পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক জলবায়ু, মানুষের করাল আঘাতসহ নানা কারণে ধ্বংস হচ্ছে আমাজন। গত ৪০ বছরে আমাজনের শতকরা প্রায় ২০ ভাগ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ২০০৪ সালে আমাজনের ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার বন উজাড় হয়েছিল, যা একটি রেকর্ড। সয়া এবং গম চাষ আমাজনের রেইন ফরেস্ট উজাড়ের জন্য অনেকটা দায়ী। পারার কাছের শহর গড়ে তুলতে ৪০০ হেক্টর জমি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল আমাজনের। বন উজাড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সেখানকার কাঠ। অবৈধভাবে উজাড় হওয়া আমাজন এখন চারণ ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অ্যামাজন ধ্বংস আমাজনের ভিতরে সোনার খনি খুঁজে বেড়ায় সংঘবদ্ধ চোরাকারবারিরা। শত শত বছর ধরে আমাজন এই সোনা সন্ধানী চোরাকারবারিদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। প্রতিদিনই আমাজনকে ধ্বংস করে চলেছে মানুষ। প্রতিদিন, প্রতি মিনিটে ১৫০ একর এবং বছরে ৭৮ মিলিয়ন একর করে ধ্বংস হচ্ছে আমাজন।