কয়েক মাস হচ্ছে পরেশবাবু শহর ছেড়ে গ্রামের চলে এসেছেন। গ্রামের পরিবেশ তিনার কাছে খুব প্রিয়। কেননা তিনি গ্রামের পরিবেশেই বড় হয়েছেন। গ্রামের স্কুল, কলেজ থেকে উচ্চ ডিগ্রী লাভ করেছেন। কেবলমাত্র চাকরির সুবাদে তিনাকে গ্রাম ছেড়ে অদূরবর্তী শহরে চলে যেতে হয়েছিল।
পরেশবাবু গ্রামে ফিরে এসে প্রথমে একটি পুরোনো বাড়িতে ওঠেন। বাড়িটি পরেশবাবুর পৈতৃক নিবাস। তিনার পূর্বপুরুষদের হাতের তৈরি। বাড়িটির চারিদিকে সবুজ গাছপালায় ঘেরা। বলতে গেলে একদম পুরোনো আমলের বাংলবাড়ি। বাড়ির দেয়ালগুলো একেবারে মরিচা ধরে গেছে। রান্নাঘরে কাঠের তৈরি কয়েকটি আলমারি ও আসবাবপত্র পড়ে আছে, যে গুলো ধীরে ধীরে ঘুণ ধরে গেছে। বাড়ির পিছনের দিকে ছোট একটা পুকুর আছে, পুকুরটি ময়লা, আবর্জনা আর কচুরিপানায় ভর্তি।
এছাড়া পরেশবাবুর যে বাড়িতে বসাবস শুরু করেছেন, সেই বাড়িটি বহুদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে থাকার কারণে বিদ্যুতের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। রাত হলেই সন্ধ্যার পর থেকে চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়ির বাইরের দিকে যেতে হলে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে যেতে হয়।
তারপরেও পরেশবাবু এমন পরিস্থিতির মধ্যে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে বাড়িটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বসাবস শুরু করেন। পরেশবাবুর পরিবারের সদস্যর সংখ্যা পাঁচজন। স্ত্রী অঞ্জলি রায়, দুইছেলে তাপস ও প্রদীপকুমার এবং বৃদ্ধ মা পারমিতা ঘোষ।
পরেশবাবুর দুই ছেলে তাপস ও প্রদীপকুমার দু'জনই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার বাড়তি চাপে তাদেরকে সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এমনকি তাদের খেলাধুলা করার সুযোগ পর্যন্ত হয়ে ওঠে না।
পরেশবাবুর খুব ইচ্ছে দুই ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলবেন। যাতে করে তিনার দুই ছেলে ভবিষ্যতে গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের পাশে দাঁড়াতে পারে এবং তাদের দুঃখ-কষ্টগুলো ভাগ করে নিতে পারে।
তারই পরিপ্রেক্ষিতে পরেশবাবু তিনার দুই ছেলেকে রনজিৎ স্যারের কোচিং সেন্টারে ভর্তি করেদেন। রনজিৎ স্যারের কোচিং সেন্টারটি বাগানবাড়ি থেকে একটু দূরে কলেজের পাশে অবস্থিত। কোচিং সেন্টারটি খুবই মনোরম পরিবেশ। শিক্ষা অর্জন করানোর গুণগতমান খুবই ভালো।
প্রতিদিন তাপস ও প্রদীপকে বাগানের রাস্তা দিয়ে রনজিৎ স্যারের কোচিং সেন্টারে পড়তে যেতে হয়। বাগানের রাস্তাটি ছিল খুব ভয়ঙ্কর। রাস্তার দুই পাশ বড় বড় গাছপালা আর লতাপাতায় ঘেরা। দিনেদুপুরে এই রাস্তা দিয়ে একা একা বাড়ি ফেরা খুব কষ্টসাধ্য। পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে গেলে কেমন যেন গা ছমছম করে। এই জন্য পরেশবাবু প্রতিদিন তাপস ও প্রদীপকে রনজিৎ স্যারের কোচিং সেন্টারে পৌঁছে দিয়ে আসতেন। আর পড়ালেখা শেষ হয়ে গেলে তাদেরকে সাথে করে বাড়ি ফিরে নিয়ে আসতেন।
একদিন পরেশবাবু তাপস ও প্রদীপকে বিকালের দিকে রনজিৎ স্যারের কোচিং সেন্টারে পৌঁছে দিয়ে আসেন। তারপর তিনি বিশেষ কাজের জন্য বাজারে দিকে ছুটে যান। কিন্তু সেদিন পরেশবাবু বাজার থেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচণ্ড জ্বর আর মাথা যন্ত্রণার কারণে থরথর করে কাঁপতে থাকেন। যার ফলে সেদিন তিনি তাপস ও প্রদীপকে বাড়ি ফিরে নিয়ে আসার জন্য কোচিং সেন্টারে যেতে পারেননি।
এদিকে কোচিং শেষ করে তাপস ও প্রদীপ বাড়ি ফেরার জন্য রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। পথ পানে চেয়ে থাকে কখন যে বাবা নিতে আসবে।
কিন্তু সেদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে অনেক রাত হয়ে যায়। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে। রাতের আকাশে কোন তারকারাজি দেখা যাচ্ছিল না। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। তবু এমন পরিস্থিতির মধ্যে সেদিন তাপস ও প্রদীপকে কেউ নিতে এলো না।
এদিকে তাপস ও প্রদীপকে কেউ নিতে না আসার কারণে তাপস প্রদীপকে বলছে, ‘দাদভাই প্রদীপ, আজ আমাদেরকে বাবা নিতে আসেনি তাতে কি হয়েছে? চল স্যারের বাসা থেকে একটা টর্চ লাইট নিয়ে আমরা দুইভাই বাড়িতে ফিরে যায়। আমাদের কপালে যা আছে তাই হবে।’ কিন্তু প্রদীপ তাপসের প্রস্তাবে রাজি হলো না। কারণ সেদিন ছিল অমাবস্যা রাত। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়ি ফেরার সময় পথের মধ্যে সমস্যার সম্মুখিন হতে হবে।
তারপরেও তাপস ছিল খুব সাহসী আর জেদি। সে জোরপূর্বক প্রদীপকে বাড়ি ফেরার জন্য মেনেজ করে। কোন উপায় না পেয়ে প্রদীপ তাপসের পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকে। কিছু পথ হাঁটার পর প্রদীপের পিছন থেকে কে যেন গলা হাঁকিয়ে বলে, প্রদীপ আমাকে বাঁচাও! ওরা আমার পরিবার পরিজনকে মেরে ফেললো। আমার সব সম্পত্তি লুণ্ঠন করে নিয়ে গেল। হঠাৎ পিছন থেকে আর্তনাদ শুনে প্রদীপ ভয় পেয়ে গেল। আর ভয় পেয়ে তাপসকে বলল, ‘ভাই তাপস, আমার পিছন থেকে কে যেন ডাকছে।’ প্রদীপের কথা শুনে তাপস তখন এদিক-ওদিক টর্চ লাইট মারলো। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাপস কাউকে দেখতে পেল না। কাউকে খুঁজে না পাওয়ার কারণে তাপস ব্যাপারটা বেশি গুরুত্ব দিলো না।
অতঃপর তারা পুনরায় হাঁটা শুরু করলো। কিছু পথ অতিক্রম করার পর আবার তাদের পিছন থেকে বলতে থাকে, আমাকে বাঁচাও! ওরা আমার পরিবার পরিজনকে মেরে ফেললো। আমার সব সম্পত্তি লুণ্ঠন করে নিয়ে গেল। এমন আর্তনাদ শুনে প্রদীপের মত তাপসও ভয় পেয়ে গেল। হঠাৎ সে চমকে উঠল। পুনরায় সে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে এদিক-ওদিক আর্তনাদকারিকে খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু কাউকে খুঁজে পেল না। এমন পরিস্থিতির মধ্যে তাপস ও প্রদীপ কোনমতে বাড়ি ফিরে এসে রাস্তার মধ্যে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনার কথা তাদের বাবার সাথে সব খুলে বলল।
তাপস ও প্রদীপের কাছে রাস্তা মধ্যে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনার কথা শুনে পরেশবাবু চমকে উঠলেন। তিনিও ভয় পেয়ে গেলেন। কেননা পরেশবাবু জানেন এই অদ্ভুত আর্তনাদ কোন মানুষের নয়, এই আর্তনাদ কোন অশুভ আত্মার আর্তনাদ। বাগানের রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় মাঝে মধ্যে তিনাকেও পিছন থেকে নাম ধরে ডাকতেন। কিন্তু তিনি পিছনের দিকে না তাকিয়ে বাড়ি চলে আসতেন।
একটু পর পরেশবাবু তাপস ও প্রদীপকে সাহস জুগিয়ে বললেন, ‘তাপস ও প্রদীপ, ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি তোমাদের কথা বুঝতে পেরেছি। রাস্তায় মধ্যে যে আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলে। সেই আর্তনাদ অশুভ আত্মার আর্তনাদ। এরা সাধারণত পুরোনো বাগানবাড়ি কিংবা বটগাছে বসাবাস করে। আমার মনে হয় এদের বসবাসের স্থানটি কেউ দখল করে নিয়েছে। যার কারণে তোমাদের একলা পেয়ে ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা করেছে।’
যাইহোক, আমি আগামীকাল তোমাদের সাথে রাস্তায় ঘটে যাওয়া অদ্ভুত রহস্যর কথা গ্রামের মানুষের কাছে তুলে ধরব এবং এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করব।
এই সব কথা বলার পর পরেশবাবু রাতের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বাড়ির ছাদে ঘুরতে গেলেন। পরেশবাবু ছাদে পৌঁছানো মাত্র কে যেন তিনাকে পিছন আর্তনাদ কণ্ঠে বলছে, পরেশবাবু আমাকে বাঁচান! আপনার মত পরোপকারী লোক এই গ্রামে একটাও নেই। আমি খুব বিপদে মধ্যে আছি। এই কথা শুনে পরেশবাবু চমকে উঠলেন। আর মনে মনে বলতে থাকলেন, তাপস ও প্রদীপের কথা তো আসলেই সত্যি। সন্ধ্যার দিকে ওরা দুইভাই আমাকে যা বলল, তাই তো আমার সাথে মিলে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে পরেশবাবু সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারেননি।
পরের দিন সকালে পরেশবাবু অশুভ আত্মার আর্তনাদের রহস্য সন্ধান জানতে প্রতিবেশী কার্তিকবাবুকে সব খুলে বললেন। কিন্তু কার্তিকবাবু ভৌতিক গল্প শুনে কোন কিছু সন্ধান দিতে পারলেন না। তখন পরেশবাবু পুনরায় কার্তিকবাবুকে বললেন, ‘কার্তিকবাবু, এই অজানা রহস্য সম্পর্কে গ্রামের কেউ কি বলতে পারবে?’ সেই মুহূর্তে কার্তিকবাবু পরেশবাবুকে বললেন, ‘পরেশবাবু, আপনার এই রহস্যময় তথ্য পেতে হলে আমার রমেশ কাকার কাছে যেতে হবে। একমাত্র তিনিই এই অশুভ আত্মার আর্তনাদের রহস্য সম্পর্কে তথ্য দিতে পারেন। চলুন এখনি ওনার কাছে যাওয়া যাক।’
অতঃপর কার্তিকবাবু পরশবাবুকে নিয়ে রমেশ কাকার বাড়িতে গেলেন। তারপর রমেশ কাকার কাছে রহস্যময় আর্তনাদের কথা কার্তিকবাবু ও পরশবাবু খুলে বললেন। রহস্যময় আর্তনাদের কথা শুনে রমেশ কাকা বললেন, ‘তাহলে তোমরা আমার কাছে একটা গল্প শোন, বহুদিন আগের কথা, বাগানবাড়ির মধ্যে দিয়ে যে রাস্তা চলে গিয়েছে, সেই রাস্তার পাশে ছিল আমার পূর্বপুরুষের আমলের একটা বিশাল বড় বটগাছ। যে বটগাছে বসাবস করত অশুভ আত্মা তথা ভূত-পেত্নীর দল। ওরা কোনদিন কারো ক্ষতি করত না। বরং ওরা যতদিন আমাদের এই অঞ্চলে ছিল, ততোদিন পর্যন্ত আমাদের অঞ্চলে কোন অভাব দেখা দেয়নি।’
কিন্তু হঠাৎ করে একদিন আমাদের গ্রামে প্রবেশ করল কিছু দুষ্ট চক্রের দল। তারা গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দিনেদুপুরে রাস্তার ধারে বড় বড় গাছপালা কেটে নিয়ে যেতো। এমনকি ভূত-পেত্নীদের বসাবসের ঐ বটগাছটি তারা একদিন কেটে নিয়ে গেল। গ্রামের বহু মানুষ বটগাছটি কাটার সময় বাধা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তারা কেউ গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের কথা শুনেনি। যার ফলে সেদিন থেকে ঐ বাগানবাড়ির রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতে গেলে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়।
ঠিকানাঃ দামুড়হুদা, চুয়াডাঙ্গা