ষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে ইরামাস ডারউইন একটি বিশেষ পরিচিত নাম। তিনি ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, উদ্ভাবক, লেখক, অনুবাদক।
নিজের লেখা ‘জুনোমিয়া’ নামে বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘যেসব প্রাণীর রক্ত গরম তারা সবাই একই সূত্র থেকে এসেছে- এই ধারণাটি খুবই সাহসী ও নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কারণ নেই। ’ এই বুড়োর নাতিই হলেন চার্লস ডারউইন।
চার্লস ডারউইনের বাবার নাম রবার্ট ডারউইন। ধর্মভীরু গোঁড়া খ্রিস্টান পরিবারে ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করে চার্লস ডারউইন।
তবে আজকের লেখায় চার্লস ডারউইনের জীবনকথা বলার জন্য নয়। একটি উদ্দেশ্যেই এই লেখা।
উদ্দেশ্যটি হলো, যে খ্রিস্টীয় সৃষ্টিতত্ত্বের বিশ্বাসের আওতায় তাঁকে মানুষ হতে হয়েছিল, তার সারাজীবনের গবেষণা কর্মকান্ড সেই বিশ্বাসকেই সমূলে উৎপাটিত করেছে।
ডারউইনের বাবা চেয়েছিলেন পুত্র ডাক্তার হোক, সেই আশা ফলবতী না হওয়ায় চাইলেন অন্তত যাজক হোক। চার্লস ডারউইন তা-ও হননি, হলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানী। ছোটবেলা থেকেই বাঁধাধরা পড়াশোনা তাকে আকর্ষণ করতে পারেনি। তার ঝোক ছিল নানা ধরনের নুড়িপাথর, মুদ্রা, নামলেখা মোহর, গাছপালা, লতাপাতা, পোকামাকড়, পাখির ডিম সংগ্রহ করে চিহ্নিত করে রাখার কাজে। এছাড়া রসায়নশাস্ত্রের প্রতি ছিল তার এক সহজাত আকর্ষণ। সাহিত্যের প্রতিও তার আকর্ষণ ছিল। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজের যাজক হওয়ার ক্লাস করতে গিয়ে যাজক হওয়া হয়নি তার। কিন্তু এই সময়েই চলতো দল বেঁধে শিকার করা, সেই সঙ্গে পোকামাকড় সংগ্রহ করে চিহ্নিত করার কাজ।
সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক জন সিভেন্স হেনস্লোর সঙ্গে। তিনি হয়ে ওঠেন চার্লস ডারউইনের প্রেরণাদাতা। দাদার লেখা ‘জুনোমিয়া’ বইটি আবার ভালো করে পড়লেন। পড়লেন লামার্কের লেখা।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ। ভবিষ্যত চার্লস ডারউইন তখন ২২ বছরের যুবক। হেনস্লোর সুপারিশে প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসাবে ‘এইচএম বিগল’ জাহাজের দীর্ঘ অভিযানের শরিক হন তিনি। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে প্লিমাইথ বন্দর থেকে বিগলের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার নানা দেশ, আন্দিজ পর্বতাঞ্চল, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জসহ নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া পরিভ্রমণ করে, কেপটাউন, সেন্ট হেলেনা হয়ে ১৮৩৬-এর ২রা অক্টোবর ফলমাউথ বন্দরে ফিরে আসে বিগলে। বিগলে জাহাজের অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলভাগের মানচিত্র তৈরির কাজে সাহায্য করা, সেই সঙ্গে সঠিকভাবে দ্রাঘিমারেখা নির্ধারণ করা।
কিন্তু প্রকৃতিবিজ্ঞানী ডারউইন পৃথিবীর গহনতম এইসব অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করলেন প্রচুর উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, মথ, প্রজাপতি, শামুক, পাথর, জীবাশ্ম, সেই সঙ্গে বিপুল অভিজ্ঞতা। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রচুর জীবাশ্ম এবং গ্যালাপাগোস দ্বীপুঞ্জের বহু বিচিত্র প্রজাতিগুলিকেই ডারউইনের যাবতীয় চিন্তাভাবনার মূল উৎস হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।
গ্যালাপাগোসের দ্বীপুঞ্জে বিরল সমস্ত প্রজাতির বিস্তারণ লক্ষ্য করেই তিনি ভেবেছিলেন, ঐসব প্রজাতি একদা মূল ভূখন্ডের পূর্বপুরুষদের মধ্যে থেকেই এসেছিল এবং পরে কোন কারণে অন্যরকম হয়ে উঠেছে- কিন্তু কেমন করে এবং কেন? এমন কি হতে পারে যে জীবনযাত্রার পরিস্থিতির সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক রয়েছে- যা সম্ভবত কতকগুলি বৈশিষ্ট্যেরই অনুকূল, অন্যগুলির নয়?
‘অরিজিন অব স্পিসিস’ সংক্রান্ত যে চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্তে ডারউইন পৌঁছান, তার ২০ বছর পর পুস্তকাকারে তার আবিষ্কার ও সিদ্ধান্ত ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হল। পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারে সংযোজিত হলো এক ঐতিহাসিক সম্পদ- অরিজিন অব স্পিসিস।
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলেন সারা দেশের ধর্মগুরুরা। এই তত্ত্ব বাইবেললোক্ত সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধী- এই বলে আক্রমণ করা হলো ডারউইন তত্ত্বকে। শুধু সভা-সমিতি নয়, কার্যক্ষেত্রে নানা ভাবে ডারউইনকে হেয় করার চেষ্টা করা হলো। মানুষকে বানরের মতো করে কার্টুন আঁকা হলো। Monkey law নামে আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে ডারউইন তত্ত্ব পড়ানো নিষিদ্ধ হলো।
তবে বইটি প্রকাশিত হওয়ার হওয়র সঙ্গে সঙ্গে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লেন ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস। পরের বছর কার্ল মার্কস এই বইটি পড়ে ১৮৬০ সালের ১৯ ডিসেম্বর এঙ্গেলসকে লিখলেন, আমাদের ধারণার প্রাকৃতিক-ঐতিহাসিক বুনিয়াদ সৃষ্টি করে দিয়েছে বইটি।
ডারউইনের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকারের উদ্দেশ্যে ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থটিতে ডারউইনের নামেই উৎসর্গ করেছিলেন মার্কস। এঙ্গেলস তার ‘ডায়লেকটিকস্ অব নেচার’ বইয়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানের জগতে তিনটি ঘটনাকে চূড়ান্ত গুরুত্ব দিয়েছেন- জীবকোষের আবিষ্কার, শক্তির সংরক্ষণ ও তার রূপান্তরের নিয়ম আবিষ্কার এবং ডারউইনের আবিষ্কার।
ডারউইন তত্ত্বের অনেককিছুই আজ আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চায় পরিত্যক্ত, সংশোধিত হচ্ছে। কিছু কিছু প্রশ্ন নিয়ে চলছে গবেষণা, বিতর্ক। এটাই স্বাভাবিক। কারণ বিজ্ঞান এগিয়ে চলে নানা জনের নানা প্রয়াসের মধ্য দিয়ে। যদিও ডারউইনের মতো দিকপালদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে ডারউইন ও তার বিবর্তন তত্ত্বের মৃত্যু নেই।
----------সংগৃহীত ----------