আলতাফ মিয়ার পুকুরে আজকাল মাছ চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়মিত হচ্ছে।ওনার বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে ওনার পুকুর, মাছ চুরি হয়ে যায় বলে বেশ কয়েকদিন পাহাড়াও দিয়েছেন ওনি, কিন্তু কোনো ফল হয় নি।দেখা যায় যেদিন পাহাড়া দিচ্ছেন সেদিন চুরি হচ্ছে না,কিন্তু যেদিনই পাহাড়া বন্ধ রাখেন চুরি হয়ে যায়।আলতাফ মিয়া সম্পর্কে আমার চাচা হন, ওনি ওনার সমস্যার কথা জনে জনে বলে বেড়ান। আমাকেও বলতে আসলেন,
আলতাফ: দুঃখের কথা আর কী বলব ভাতিজা।কত আশা নিয়ে পুকুরে মাছ চাষ করছিলাম।বিশ হাজার টাকার মাছের পোনা ছেরেছি। ভাবছিলাম লাখ টাকার মাছ বিক্রি করব।এখন দেখ, কোন অলক্ষুণে চুর আমার পুকুরের মাছ চুরি করে নিচ্ছে।
আমি:চাচা, আপনার পুকুরে যেদিন পাহাড়া দেন ওইদিন তো চুরি হয় না বলে শুনলাম।তাহলে পাহাড়া দেওয়ার ব্যাবস্থা করুন।
আলতাফ: পাহাড়া দেই দিন চুরি হয় বললে তো লোকে ভূতের পুকুর ভেবে আমার পুকুরের মাছ খাবে না। জহিরের পুকুরের যেমন হয়েছে। আমি যেদিন পাহাড়া দেই,সেদিনও চুরি হয়ে যায় মাছ।
আমি: আপনি কাওকে দেখেন না???
আলতাফ:এখন শীতকাল, আর কুয়াশাও প্রচুর পড়ে,যার জন্য পুকুরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা দেখা যায় না।
আমি: চাচা, মাছ কেমন পরিমাণে চুরি হয়ে যায়???
আলতাফ: আমার পুকুরে রুই মাছ, কার্ফু মাছ আর কাতলা মাছ চাষ করি। মাছগুলো এখন কিছুটা বড় হয়েছে। প্রতি রাতে অনেকগুলো মাছ গায়েব হয়ে যায়। মাছ তো আর গুণে বলা যায় না।
আমি: খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার মনে হচ্ছে।চাচা আমিও আজ রাতে আপনার সাথে পাহাড়া দিব।
আলতাফ: আচ্ছা পাহাড়ায় এসো।আজ গঞ্জে একটু কাজ আছে,কাজ শেষ হয়ে গেলে আমি তোমায় ডেকে নিয়ে যাব।
আমি:আচ্ছা চাচা, যখন পাহাড়া দিতে যাবেন,আমায় ডাক দিবেন।
আমাদের কথা বার্তা এখানে শেষ হয়ে গেল। আমি পাহাড়া দিতে রাজি হলাম কারণ ছোট বেলা থেকেই আমার জ্বীন ভূতের প্রতি আগ্রহ বেশি, শুনেছি মাছের পুকুরে এইসব জিনিস থাকে। ভাবলাম এবার হয়তো জ্বীন ভূত দেখতে পাব।
রাতের বেলা শুয়ে আছি, দরজায় কড়া নাড়ল একজন।আর আমার নাম ধরে ডাকও দিল।কন্ঠ শুনে বুঝলাম আলতাফ চাচা। রাতের বেলা তিনবার কারও ডাক না শুনে ঘর হতে বের হতে নেই,ছোট বেলায় দাদা বলত। তাই তিনবার আমার নাম ধরে ডাক দেওয়ার পর আমি সাড়া দিয়ে বের হয়ে আসলাম। ঘর হতে বের হওয়ার সময় দেওয়াল ঘড়িতে দেখলাম রাত ১০ টা বাজে, হাতে একটা টর্চ লাইট নিয়ে আলতাফ চাচার সঙ্গে তার পুকুরের দিকে চলতে লাগলাম। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুইজন কথা বলছিলাম।
আমাদের বাড়ি থেকে ওই পুকুরে যেতে কমপক্ষে ২০ মিনিট লাগে। কিন্তু আজ পুকুরে আসতে আমার মনে হলো ৫ মিনিটের মতো লেগেছে। বিষয়টা অবাক করার মতো হলেও আমি তেমন পাত্তা দিলাম না। ভাবলাম কথা বলে বলে আসছি, তাই হয়তো দ্রুত চলে এসেছি বলে মনে হচ্ছে। আলতাফ চাচার পুকুরে আসার পর পুকুরটা আবারও দেখলাম। প্রায় ৪ কাঠা জমির উপর পুকুর, ওনার বাপ দাদার আমলের পুকুর, আগে ওনারা কেউ মাছ চাষ করত না। আলতাফ চাচা ই সর্বপ্রথম মাছ চাষ শুরু করেছেন।পুকুরের চারদিকে সুপাড়ি আর নারিকেল গাছ লাগানো হয়েছে। পুকুরটার উত্তরদিকে কবর স্থান আছে।দিনের বেলা কতোবার কবর স্থান দিয়ে যাই, কোনো রকম ভয় লাগে না। আজ কবর স্থানের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন শরীর শিরশির করতে লাগল। আজ আমাবস্যা, শীতের দিন বলে কুয়াশাও পড়েছে প্রচুর।উত্তর দিকের ঠান্ডা বাতাস শরীর কাপিয়ে দিচ্ছে বারবার। আলতাফ চাচার সাথে কথা বলে ঠিক করলাম দুজন দুইদিক দিয়ে বসে পাহাড়া দিব। আমার স্থান পড়ল পশ্চিম দিকে, এখানে একটা বসার জন্য মাঁচা বানিয়ে রাখা হয়েছে। আমিও বসে আছি পাহাড়া, দিচ্ছি। একেই আমাবস্যা,তার উপর ঘন কুয়াশা পড়ছে, ফলে পুকুরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা দেখা যায় না।বারবার লাইট জ্বালিয়ে পুকুরের সব দিক লক্ষ্য করছি। কয়েকবার চিৎকার করে একজন আরেকজনের উপস্থিতির প্রমাণ দিলাম।
এতোক্ষণ সময় স্বাভাবিকভাবেই চলতে লাগল। রাত আনুমানিক তিনটার সময় আলতাফ চাচার নাম ধরে ডাক দিলাম।কোনো সাড়া পেলাম না। আরও কয়েকবার ডাক দেওয়ার পরেও যখন সাড়া পেলাম না,ভাবলাম হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। এভাবে ঘুমালে তো চোর অতি সহজেই মাছ চুরি করে নিয়ে যাবে।তাই আলতাফ চাচাকে ডাক দিতে গেলাম। গিয়ে দেখি ওইদিকে কেউ নাই। আমার কেমন যেন খটকা লাগতে লাগল। আমি আশেপাশে লাইট মারতে লাগলাম, কিন্তু কোথাও কেউ নাই। আলতাফ চাচার নাম ধরে আবারও ডাক দিলাম, কিন্তু সাড়া পেলাম না। সাড়া দিল সুপাড়ি গাছে বসে থাকা একটা পেঁচা।রাতের বেলা পেঁচাকে অনেক ভয়ঙ্কর লাগে। আমি ভাবলাম হয়তো অনেক ঠান্ডার কারণে ওনি বাড়ি চলে গেছেন, তাই ভাবলাম আমি একা বসে থেকে কী করব???আমিও বাড়ি চলে আসার জন্য রওনা দিব তখন আমার নাম ধরে আলতাফ চাচা ডাক দিল।আমি শব্দের উৎসের দিকে তাকালাম,দেখলাম আলতাফ চাচা পুকুরের পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছেন। আমায় বলতে লাগলেন, "শফিক আমায় পানি থেকে তোল, পানি খেতে খেতে মরে যাব, তাড়াতাড়ি আয়।"
আমি তো জানতাম আলতাফ চাচা সাঁতার জানেন।তাহলে আজ কী হলো??? এসব ভাবনা চিন্তা মাথা থেকে দূর করে আর প্রচন্ড ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে পুকুরের পানিতে ঝাপ দিলাম। আমি যতোই আলতাফ চাচাকে ধরার জন্য সাঁতরে সামনে যাচ্ছি,আলতাফ চাচাও ঠিক ততোটা পিছনে চলে যাচ্ছে।এভাবে সামনে যেতে যেতে আমি পুকুরের মাঝখানে চলে আসলাম।তখন সামনে তাকিয়ে দেখি আলতাফ চাচা নাই।বুঝলাম এটা হয়তো কোনো ভূতুরে কান্ড হচ্ছে আমার সাথে।তাই দ্রুত পুকুর থেকে উঠার জন্য পাড়ের দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। কিন্তু তখনই ঘটল বিপত্তি,আমার পায়ে দড়ির মতো কিছু একটা পেঁচিয়ে ধরল,আর আমার পায়ে কারও হাতের টান অনুভব করলাম। কেউ একজন আমার পায়ে ধরে আমায় পুকুরের নিচে নিতে চেষ্টা করছে।আমিও ভেসে থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু এভাবে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না।ডুবে যাওয়ার আগ মূহূর্তে ছোট বেলায় দাদার বলা একটা কথা মনে পড়ল, দাদা বলেছিলেন,
"আমাবস্যা রাতে কখনও কোনো ভূতুরে জায়গায় যেতে নেই,এইদিন অশরীরীদের শক্তি বেড়ে যায়।"
পরেরদিন সকাল বেলায় গ্রামের কয়েকজন লোক আমায় পুকুরপাড়ে অজ্ঞান অবস্থায় পায়। তবে সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো আমার পুরো শরীর শুকনো ছিল,একটু জায়গাও ভিজা ছিল না। আর আলতাফ চাচা নাকি ওইদিন গঞ্জে প্রচুর কাজের জন্য বাড়ি আসেন নি। তাহলে কে আমায় ডেকে নিয়ে গেল??? আর আমার শরীর সম্পূর্ণ শুকনা কী করে ছিল?