এক কাঠুরিয়া। ছেলে হয় না পিলে হয় না, সকলে “আঁটকুড়ে আঁটকুড়ে” বলিয়া গালি দেয়, কাঠুরিয়া মনের দুঃখে থাকে। কাঠুরিয়া-বউ আচারনিয়ম ব্রত উপোস করে, মা-ষষ্ঠীর-তলায় হত্যা দেয়-“জন্মে জন্মে, কত পাপই অর্জে ছিলাম মা, কাচ্চা হক্ বাচ্চ হক্ অভাগীর কোলে একটা কিছু দে মা, ভিটে বাতির নি’র্শন থাক।” কাঁদিতে, কাঁদিতে-মা ষষ্ঠী এক রাতে স্বপন দিলেন,-“উঠ্ লো উঠ্, তেল সিঁদুরে না’বি ধুবি, শশা পা’বি শশা খা’বি। কোলে পাবি সোনার পুত বুকজুড়ানো মাণিকটুক্।” কাঁচা পোয়াতীর ঘুম ভাঙ্গে নাই, কাক পক্ষী মাটি ছোঁয় নাই, ভোর জ্যোছনায়, এক কপাল সিঁদুর আঁজলপূরা তেল মাথায় দিয়া কাঠুরে- বউ ষষ্ঠীমা’র ঘাটে নাইয়া ধুইয়া ডুব দিয়া আসিল। আদেশ হইয়াছে, আর কি! “শশা যদি পাস শশা খাস্” বলিয়া, মনের আনন্দে কাঠুরিয়া কাঠ কাটিতে বনে গেল। বনে ঝরণার পাড়ে একশ’ বচ্ছুরে খুনখুনে’ এক একরত্তি বুড়ী! “কে বাছা আঁটকুড়ে’ কাঠুরিয়া? চক্ষেও দেখি না মক্ষেও দেখি না ছাই,- এই নে বাছা, এইটে নিয়ে বউকে দিস, কিছু যেন ফেলে না, সাতদিন পরে যেন খায়, চাঁদপানা টলটল হাতী হেন ছেলেটা-কোলজোড়া-ঘর আলো করবে।” এতটুকু এক থলে খুলিয়া ছোট্ট এক শশা কাঠুরের হাতে দিয়া গুটি গুটি বনের মধ্যে চলিয়া গেল। আর কাঠ কাটা!-এক দৌড়ে কাঠুরিয়া বাড়ী, “ও অভাগী আঁটকুড়ি! –এই দ্যাখ, এই নে হাতে-পাতে মা-ষষ্ঠীর বর! আজ যেন খাস নি, সিকায় তুলে রাখ, সাত দিন পরে খা’বি।” মনের আহ্লাদে তিন খবল তেল মাথায় দিয়া কাঠুরিয়া নাইতে গেল। কিছু যে ফেলিতে মানা, মনের ভুলে কাঠুরিয়া তা’ বলিয়া গেল না। “সাত দিন না সাত দিন! মা ষষ্ঠী বলেছেন,- ‘শশা পা’বি শশা খা’বি।’ হাতে পায়ে জল দিয়া “মা ষষ্ঠী, মা ষষ্ঠী” নাম নিয়া, কাঠুরে-বউ বোঁটা সোটা ফেলিয়া কপালে কণ্ঠায় ছোঁয়াইয়া কুচ্মুচ্ শশাটি খাইয়া ফেলিল। নাইয়া দাইয়া আসিয়া কাঠুরিয়া দাওয়ায় খাইতে বসিবে, দেখে শশার বোঁটাটা!-“ও সর্বনাশি!”-শশা তো খাইয়াছে!- “আ অভাগী কুলোকানি!- করেছিস কি রাক্ষসী!-খেলি তো খেলি, বোঁটা কেন ফেললি! শীগগির তুলে খা!” “ওমা-কি হয়েছে?” থতমত কাঠুরে-বউ বোঁটা তুলিয়া খাইল। গালে মাথায় চাপড় দিয়া কাঠুরিয়া ভাতের থাল ছুঁড়িয়া ফেলিল। ২ আর কিসে কি!-এত ধর্ণা, এত কর্ণা, কাঠুরে-বউর যে ছেলে হইল-ও মা!- ‘জন্মিতে জন্মিতে বুড়ীর চুল দাড়ি আঠারো কুড়ি। এক দেড় আঙ্গুলে’ ছেলে’, তা’র তিন আঙ্গুলে’ টিকি! “না বলতে শশা খেলি, বুড়ির শাপে পাতাল গেলি!” দুই চক্ষু কপালে তুলিয়া রাগিয়া মাগিয়া দড়িকুড়াল নিয়া কাঠুরিয়া একদিকে চলিয়া যায়!- “সাত দিন পরে খেলে হাতীর মতন ছেলে হইত, বোঁটাটা হাতীর শুঁড় হইত!-তা নয়,- হয়েছেন এক টিকটিকি,-বোঁটা হয়েছেন তিন আঙ্গুলে’ এক টিকি-এক বিঘত ধানের চৌদ্দ বিঘত চাল। কাঠুরে-বউ তো ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিল। “ওঙা, ওঙা!” ছেলে কাঁদে, কে নেয় কোলে, কে করে যতন, কাঠুরে’ তো গেলই, কাঠুরে-বউ নদীর জলে ঝাঁপ দিয়া মরিতে চলিল- “দিলি দিলি এমন দিলি! মা ষষ্ঠী, তোর মনে এই ছিল!” আঙ্গুল চুষিয়া দেড় আঙ্গুলে’ ছেলে খাড়া হইল! দৌড়িয়া গিয়া তিন আঙ্গুলে’ টিকি দিয়া মায়ের পা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল,-“মা, মা! যাসনি আমায় একটু দুধ দে।” “মা!- জন্মিয়াই ছেলে কথা কয়! সামান্যি তো নয় মা, সামান্যি তো নয়!” চোখের জল মুছিয়া “ষাঠ্ ষাঠ্” ধূলা ঝাড়িয়া কাঠুরে-বউ ছেলে তুলিয়া কোলে নিল। পেট ভরিয়া দুধ খাইয়া দেড় আঙ্গুলে’ বলিল, “মা, এখন নামিয়ে দে, বাবাকে নিয়ে আসি!” ৩ বাবা কোন্ রাজ্যে কোথায় গেছে, তুরতুর করিয়া দেড় আঙ্গুলে’ পথ ঘাট ছাড়ায়। পিঁপড়ে আসে, গুবরে আসে, ফড়িং যায়- দেড় আঙ্গুলে’র সঙ্গে কেউ পারে না; দেড় আঙ্গুলে’ হটিং হটিং করিয়া হাঁটে, ফড়িং ফড়িং করিয়া নাচে। হাঁটিতে হাঁটিতে, নাচিতে নাচিতে এক রাজার বাড়ীর কাছে গিয়া দেড় আঙ্গুলে’ দেখে, ঠা ঠা রৌদ্রে মাথার ঘাম পায়ে, তার বাবা, কাঠ কাটিতেছে। দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“বাবা, আমায় ফেলে এলি কেন?-বাড়ী চল। মা কত কাঁদছে।” কাঠুরে অবাক!-ছেলে তো সামান্য নয়!-বুকে তুলিয়া চুমা খাইয়া বলিল,-“বাপ আমার সোনা কি করে যাই, রাজার কাছে আপনা বেচেছি।” দেড় আঙ্গুলে’ রাজার কাছে গেল। “রাজা মশাই, রাজা মশাই, রাজ-রাজ্যের কাঠ কাটে কে?” রাজা-“কে রে তুই?-কাঠ কাটে অচিন দেশের নচিন কাঠুরে।” দেড় আঙ্গুলে’-“কাঠুরেটি কোথায় থাকে? কাঠুরেটি দাও না মোকে।” রাজা-“নিয়ে এল হাটুরে’, কড়ি দিয়ে কিনলাম কাঠুরে’- ব্যাটা বড় মস্তকী, সেই কাঠুরে’ তোরে দি।” দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“তবে কি?” রাজা-“নিয়ে এসে কড়ি, তবে আসিস রাজ-রাজড়ার পুরী।” শুনিয়া, দেড় আঙ্গুলে’ গিয়া বলিল,-“বাবা, তুমি কিছু ভেবো না, আমি দেখি, কড়ি আনতে চল্লাম।” ৪ ভাঁটার মতন ছোটে, কুতুর কুতুর হাঁটে-একখানে আসিয়া দেড় আঙ্গুলে’ দেখিল; এক খাল। কেমন করিয়া পার হইবে? বসিয়া বসিয়া দেড় আঙ্গুলে’ ভাবিতে লাগিল। পিছনে, টিকিতে ইয়া এক টান!- “হেই দেড় আঙ্গুলে’ মানুষ তিন আঙ্গুলে’ টিকি! তুই কে রে?” টিকির টানে চিৎপটাঙ, তিন গড়াগড়ি দিয়া উঠিয়া চটিয়া মটিয়া দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“আমি যে হই সে হই, তুই বেটা কে রে?” ব্যাঙ বলিল,- “ব্যাঙ রাজার রাজপুত্তুর রঙ, সুন্দর ব্যাঙ।” দেড় আঙ্গুলে বলিল,-“তোর নাক কাটব কান কাটব, কাটবো দুটো ঠ্যাং।” ব্যাঙ “হো হো” করিয়া হাসিয়া ফেলিল,- “টিং টিঙা টিং টিঙা। কাটবি কি তুই ঝিঙা। নাকও নাই, কানও নাই, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ্গ্ ঘিঙা।” বলিয়া ব্যাঙ নাচিতে লাগিল। দেড় আঙ্গুলে’ বড়ই ঠকিয়া গেল। নাচিয়া নুচিয়া ব্যাঙ বলিল- “ভাই, তুই কি রে?” “কাঠুরে।” “তবে তোর কুড়ুল কৈ রে?” “নাই রে!” “দুয়ো!-উতরে এক কামার আছে, এক কড়া কড়ি দিয়া কুড়ুল নিয়া আয়।” দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“না ভাই, আমি কড়ি কোথায় পাব? কড়ি নাই বলেই তো বাবাকে আনতে পারলেম না। আমি ছোট ছেলে মানুষ, আমার কিছু আছে কি না। তোর থাকে তো ধার দে না ভাই?” “ও বাবা”-ব্যাঙ চমকিয়া উঠিল-“আমার মোটে কানা এক কড়ি, তাই তোমাকে দি!-ঘ্যাংঙ ঘ্যাংঙর ঘ্যাঙ।” -লাফে লাফে ব্যাঙ চলিয়া যায়।–“তা যদি কুড়ুল আনিস তো-” দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“আচ্ছা,-কুড়ুল-কোন্ পথে বলিয়া দে।” “তবে যা!” পথের কথা বলিয়া দিয়া ব্যাঙ কচুর পাতার নীচে বসিয়া রহিল। একখানে এক ছোট্ট ঘর, তারি মধ্যে এক আড়াই আঙ্গুলে’ কামার তিন আঙ্গুল দাড়ি নাড়িয়া এক পৌনে আঙ্গুল কুড়াল আর এক কাস্তে গড়িতেছে। কড়ি নাই ফড়ি নাই, কি দিয়া কি করে?-তা কুড়ুল না নিলেও তো নয়! চুপ্টি চুপ্টি, আড়াই আঙ্গুলে’ কামারের পিছনে গিয়া, দাড়ির সঙ্গে টিকিটি বাঁধিয়া দিয়া দেড় আঙ্গুলে’ “চ্যাঁ ম্যাঁ” করিয়া চেঁচাইয়া একলাফে একেবারে আড়াই আঙ্গুলে’র ঘাড়ে! “আ-আ আমঃ! রাম রাম- দুগ্গা-দুগ্গা!! দুগ্গা!!!” বুড়া ছিটকাইয়া উঠিয়া ডরে ঠি ঠি করিয়া কাঁপে। কি না কি,-ভূত না প্রেত!! হাসিতে হাসিতে পেট ফাটে, হাসিতে হাসিতে গলিয়া পড়ে, নামিয়া আসিয়া দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“কামার ভাই, কামার ভাই; ডরিও না, তোমার সঙ্গে মিতালী!” মিতালী আর ফিতালী-আড়াই আঙ্গুলে’ খুব রাগিয়া গিয়াছে, বলিল, -“কে রে তুই? ঘরে যে উঠিয়াছিস, কড়ি এনেছিস?” ও বাবা! সকলেই কড়ি!-“সে কি ভাই, কড়া কড়ি আবার কিসের?” “আমার ঘরে উঠলেই কড়ি!” “তবে ভাই টিকি খুলিয়া দাও, আমি যাই!” আড়াই আঙ্গুলে’ টিকি খুলিতে খুলিতে টিকির এক চুল ছিঁড়িয়া গেল। চোখ রক্ত করিয়া তখন দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“এইও বড়ো! আমার টিকি ছিঁড়লি যে!-এইবার কড়ি ফ্যাল।” কামার বুড়ো ভ্যাবাচাকা; বলিল,-“অ্যাঁ-অ্যাঁ-তা’ ভাই, কড়ির বদল কি নিবে নাও।” তখন দেড় আঙ্গুলে’ কড়ির বদলে কুড়ুলটি চাহিয়া, বলিল,-“আজ থেকে তোমায় আমায় মিতালী।” কুড়ুল আনিলে ব্যাঙ বলিল,-“ভাই দেড় আঙ্গুলে’, আমি ব্যাঙ-রাজার ব্যাঙ রাজপুত্র, এক কুনোব্যাঙী বিয়ে করেছিলাম, তাই বাবা আমাকে বনবাস দিলেন। আমার কুনোরাণী ঐ ভেরেণ্ডা গাছে লাউয়ের খোলসের মধ্যে,-তার সঙ্গে আর কিছুই নাই, কেবল এক ঘাসের চাপাটী আর এক সাতনলা আছে। তুমি ভাই গাছটা কাটিয়া আমার কুনোরাণীকে পড়িয়া দাও।” বলতে না বলতে পৌনে আঙ্গুল’ কুড়ুল ঠকাঠক! দেখিতে দেখিতে হড়্ মড়্ করিয়া গাছ পড়িল। খোলসটি কিনা মস্ত বড় উঁচু? হাঁ করিয়া খাড়া হইয়া খাড়া হইয়া রহিল! টানিয়া টুনিয়া ব্যাঙ বলিল,-“ভাই, এত করিলে অত করিলে, সব মিছা!” চক্ষের জলে ব্যাঙের বুক ভাসে। দেড় আঙ্গুলে’ বলিল-“রও!” চট্পট ডালের উপর উঠিয়া চিৎ হইয়া, টিকিটি খোলসের মুখে ঝুলাইয়া দিয়া বলিল,- “কুনোরাণী, কুনোরাণী জেগে আছ কি? শক্ত করে ধরে উঠ, সিঁড়ি দিয়েছি।” টিকি ধরিয়া কুনোরাণী উঠিয়া আসিল! ব্যাঙ বলিল.-“ভাই, ভাই, আমার কানা কড়িটি নাও। এইটি দিয়ে তোমার বাপকে কিনিয়া নিও।” কুনোরাণী বলিল,-“রাজার জামাই দেড় আঙ্গুলে’, আমার এই থুথুটুকু নাও, রাজার কানা রাজকন্যা-ইহাই নিয়া রাজকন্যার কানা চোখ ফুটাইও!” সাতনলা আর খোলসটি বলিল.- “রাজার জামাই দেড় আঙ্গুলে’ সাবাস সিপাহি! মোদের নাও সাথে করে’ পাবে রাজার ঝি।” সব নিয়া দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“এখন ভাই আসি?” ৫ আবার হটিং হটিং, আবার ফটিং ফটিং; রাজার কাছে গিয়া দেড় আঙ্গুলে’ হাঁক ছাড়িল,- “রাজা মশাই, রাজা মশাই, কড়ি গুণে’ নাও, আপন কুড়ি বুঝ পড়; কাঠুরেটি দাও।” রাজা কড়ি গুণে, বুঝে নিয়ে,- টিকিতে তিন টান, দুই গালে দুই চাপড়, দেড় আঙ্গুলে’কে খেদাইয়া দিলেন,- “তের নদীর পারে আছে সাত চোরের থানা, তারি কাছে দিব বিয়ে রাজকন্যা কানা। সেই চোরদিগে আগে নিয়ে এসে, কথা ক’।” দেড় আঙ্গুলে’ আবার ব্যাঙের কাছে গেল,- “রঙসুন্দর রাজপুত্তুর কোথায় আছ ভাই! তের নদী পার হব, দুটো কড়ি চাই।” ব্যাঙের তখন মেলাই কড়ি; বলিতে না বলিতে ব্যাঙ কড়ি আনিয়া দিল। দুই কড়ির এক কড়ি দিয়া দেড় আঙ্গুলে’ তের নদী পার হইয়া, কোথায় সাত চোর, তাদের খোঁজে চলিতে লাগিল! সারাদিন খুঁজিয়া পাইল না,-অনেক দূরে এক উইয়ের ঢিপির কাছে গিয়া সন্ধ্যা। সারাটি দিন খায় নাই, আজো বাবাকে পায় নাই; গা অলস, মন অবশ, উইয়ের ঢিপির তলে কুড়ুল শিয়রে দিয়া দেড় আঙ্গুলে শুইতে শুইতেই ঘুমাইয়া পড়িল। অনেক রাত্রে, সাত চোর তো নয়,-সাড়ে সাত চোর সেইখান দিয়া চুরি করিতে যায়। অন্ধকারে কিছু দেখে না, সাড়ে সাত চোরের আধখানা-চোর ছোট-চোরের পা দেড় আঙ্গুলে’র ঘাড়ে পড়িল; ধড়্মড়্ উঠিয়া দেড় আঙ্গুলে’ চোরের পায়ে কুড়ুলের এক কোপ।–“কে রে ব্যাটা নিমকানা, চলেন তিনি পথ দেখেন না।” ছোট চোর হাঁউ হাঁউ করিয়া চেঁচাইয়া তিন লাফে সরিয়া গেল; সকল চোর অবাক,-জন নাই প্রাণী নাই, মাটির নীচে কথা! “দোহাই বাবা দৈত্য দানা, ঘাট হয়েছে, আর হবে না।” শুনিয়া দেড় আঙ্গুলে’ বড় খুসী হইল, বলিল,-“যাক ভাই, যাক ভাই-তা ভাই, তোরা কে রে?” সাড়ে সাত চোর বলে,- “আমরা সাড়ে সাত চোর,- মাটি ফুঁড়ে কথা কও, তুমি তো ভাই কম নও, তুমি ভাই কে?” “আমি ভাই, মানুষ,- এই যে আমি, এই যে!- তোমরা ভাই, কোথা যাচ্ছ ভাই?” উঁকি ঝুঁকি, হাতাড়ি পিতাড়ি-শেযে ছোট্ট চোর দেখে- ও বাব্বা-এক একটুখানি দেড় আঙ্গুলে,’ তার আবার কুড়ুল হাতে! হাত তুলিয়া চোখের কাছে নিয়া দেখে,-ওঁম্মা!- তিনি আবার টিকি ফর্ ফর্ তিন ভঙ্গী রাগে গর্ গর্- টিকির আগে ভোমরা, ইনি আবার কোন্ দেশী চেঙ্গরা? হো হো! হি হি! হু হু! হা হা! হে হে! হৈ হৈ! হৌ হৌ!!-হঃ হঃ। সাড়ে সাত চোরে যে হাসি। গলিয়া ঢালিয়া গড়া-গড়ি!! শেযে কোন মতে তো হাসি থামুক; চোরেরা বলিল,-“চল্ রে চল্ আড়াইয়ের বাড়ীতে যাই।” দেড় আঙ্গুলে’ জিজ্ঞাসা করিল,-“আড়াইয়ে কে ভাই?” “তুই হলি দেড়কো, তুই জানিস নে? ওপারে আড়াইয়ে এক কামার আছে, সাড়ে সাতটা সিঁদ-কাটি দিবে, ব্যাটা রোজ ফাঁকি দেয়, আজ সেই বুড়োকে দেখাব।” দেড় আঙ্গুলে’ দেখিল,-ওরে! তা’র সঙ্গে আমার মিতালী, তারি ঘরে সিঁদ দেবে?-বলিল,- “ও ভাই! সে বাড়ী যাস নি, সে বাড়ীতে আছে শাকচুন্নী; ঘাড়টি ভেঙ্গে রক্ত খাবে, সাড়ে সাত গুষ্টি এক্কেবারে যাবে। তা’ তো নয়, রাজকন্যা বিয়ে করিস তো, রাজার বাড়ী চল।” চোরেরা “হি হি হি! হে হে হে! হৈ হৈ হৈ! সে তো ভালই, সে তো ভালই!” তা রাজার জামাই হবে, তারা কি যে সে! গোঁফে তা, গায়ে মোড়ান চোড়ান, বলিল,-“তা যেখানে যেতে উথাল পাতাল তের নদীর জল।” দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“কেন, এই যে ওপার যাচ্ছিলি!” “যাচ্ছিলুম তো যাচ্ছিলুম, করতে যেতুম চুরি,- রাজার জামাই হব, তাও দিয়ে আপন কড়ি?” দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“আচ্ছা, একটা কড়ি আছে, নিয়ে চল!” কড়ি নিয়া ভারী খুসী সাড়ে সাত চোর নদীর পাড়ে দিয়া ডাকিল,- “হেই হেই পাটনি! রাত জাগা খাটুনী,- করবি পার পাবি কড়ি তাতে কেন গড়িমড়ি?- পাটনী না পাটুড়ী বজ্জর বাঁধের আঁটুনী। কানা কড়ির আশটা কানা কড়ির বাসটা রাজবাড়ীর মাছটা বিড়ালে খায়, হেদে হেদে পাটনি, ঝট্ পট্ পার করে নে ভাঙ্গা নায়!!” কড়ি নিয়া, পাটনী ভাঙ্গা নায়ে করিয়া পার করিয়া দিল। নামিবার সময় চোরেরা আবার কড়িটি চুরি করিয়া নিল। দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“না ভাই, কড়ি ফিরিয়ে দিয়ে এস।” “হুঁ! দিব না তো কি, সাত হাঁড়ি ঘি!” চোরেরা মুখটা নাড়া দিয়া উঠিল। দেড় আঙ্গুলে’ আর কিছুই বলিল না। যাইতে যাইতে রাজার বাড়ী। দেড় আঙ্গুলে’ গিয়া রাজার দুয়ারে ঘা দিল,- “রাজামশাই, রাজামশাই, খাট পালঙ্ক ছাড়, পার হয়ে না দেয় পারের কড়ি, কেমনে ঘুম পাড়?” চোরেরা থরথর কাঁপে। রাজা বলিলেন,-“কে! পারের কড়ি না-দেয় তারে শূলে চড়িয়া দে।” সাড়ে সাত চোর শূলে গেল। “শূলে গেল কি সাত চোরেরা? হায়! হায়! হায়!” রাজা কাঁদেন, রাণী কাঁদেন, কানা কন্যা কাঁদেন, দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“চোর তো আমি এনে দিয়েইছিলাম, তা’ রাজকন্যার বর হবে, না, আপন দোষে শূলে গেল,-তা’র আমি জানি কি? রাজামশাই, কাঠুরে’ দাও!” “কিরে!-বারে বারে ভ্যান্ ভ্যান্ বারে বারে ঘ্যান্ ঘ্যান্! দে তো নিয়ে ক্ষুদে’টাকে চোরেদের সঙ্গে!” ফুট্!-দেড় আঙ্গুলে’কে কেউ খুঁজিয়াই পাইল না। চোরের রাজ্যে, চোরের রাজা, সাড়ে সাত চোরের শূলের কথা শুনিল। নায়ে নায়ে ভরা দিয়ে যত রাজ্যের চোর আসিয়া রাজার রাজপুরীময় চুরি আরম্ভ করিল। সিপাহী শান্ত্রী ধোঁকা, রাজা হলেন বোকা!- নিতে নিতে- চাটি নিল বাটি নিল, সব নিল চোরে, মাটি পেতে পান্তা খান, রাজা মনে মনে পুড়ে’। তখন,-“চোরের বাদী সেই ক্ষুদে’ তারে এখন এনে দে!” কোথায় বা ক্ষুদে,’ কোথা খুঁজিয়া পায়! দেড় আঙ্গুলে’ ঘাসবন থেকে হাসিতে হাসিতে আসিয়া বলিল,-“রাজামশাই, রাজামশাই, এত এত সিপাই চোরের কাছে ঢিপাই; আমার কাছে ঘুরসুড়নি এমন সিপাই জন্মেও নি। তা’ যদি বল’ তো সব চোর তাড়িয়ে দি!” “আচ্ছা, কি চাও?” “রাজকন্যা চাই।” “ইস্ কথা দেখ!-আর কি?” “পুরীর রাজা হুলো বেড়ালটি।” “আর কি?” “পোযাক আষাক, হীরের পাগড়ী।” রাজা সব দিলেন, কেবল বলিলেন,-“চোর যদি ছাড়ে পুরী, তবে কন্যা দিতে পারি।” কানা কন্যা গেলেই কি, থাকলেই কি। তখন কেশ-বেশ পোষাক করিয়া, হুলোবেড়াল ঘোড়া, সাতনলা হাতে, টিকির নিশান মাথে, টিকিতে খোলস বেঁধে, দেড় আঙ্গুলে’ চোরের রাজ্যে গিয়া হানা দিল। কোথা দিয়া কোথা দিয়া যায়, বিড়ালে হাঁড়ি খায়,-যত চোরনী পরেশান! খোনা, খুন্তি, পোলো, থোলো, রায়বাঁশ, গলফাঁস, সকল নিয়া রাজ্যের যত চোর অলিতে গলিতে খাড়া হইল, খানা খুঞ্জি ঘিরিয়া দাঁড়াইল। দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“আচ্ছা রও! সাতনলা, সাতনলা, করছ এখন কি? চুপটি করে আছ কেন লাউয়ের খোলসটি?’ সাতনলা বলিল,-“কি?” খোলস বলিল,-“কি?” নল চিরিয়া হাজার চুল, খোলস ফেটে ভীমরুল! চেরা চেরা নল সূঁচ হেন ছোটে, ভীমরুলের হুল পুট্পুট্ ফোটে।– “আঁই মাঁই কাঁই; বাবা রে! মা রে! তালুই রে! শ্বশুর রে।”-চোরের রাজ্যে হুড়াহুড়ি গড়াগড়ি, লটাপটি ছুটাছুটি!- তিন রাত্তিরে ঘর দোর ফেলে যত চোর চোরনী দেশ ছেড়ে পালিয়ে পুলিয়ে দূর!-চোরের রাজা ‘চ্যাং পিছলে’; চ্যাং পিছলেকে বাঁধিয়া নিয়া দেড় আঙ্গুলে’ টিকি ফরর্ ফরর্ পাগড়ী ফুলাইয়া নল ঘুরাইয়া রাজার কাছে গেল,- “রাজামশাই, রাজামশাই, রাজকন্যা আর কাঠুরে দাও।” তখন রাজা বলেন,-“তাই তো! তাই তো!- বীরের চূড়া পিপ্পল কুমার, এস রে বাপ, এস, তোমার তরে রাজ্য ধন, সিংহাসনে বস। কন্যা আছে চোখ-বিঁধুলী, দিলাম তোমার দান- কাঠুরেরে আন দিয়ে পুষ্পরথ খান।” পুষ্পরথে চড়িয়া কাঠুরিয়া আসিল। তখন, কুনোরাণীর থুথু দিয়া দেড় আঙ্গুলে’ পিপ্পল কুমার রাজকন্যার চোখ ফুটাইল;-ব্যাঙ এল, কুনোরাণী এল; দেড় আঙ্গুলে’ গিয়া কামার মিতাকে আনিল। ধুম ধাম বিয়ে সিয়েয় রাজ-রাজ্য তোল-পাড়! লাফে লাফে ব্যাঙ নাচে, দাড়ি নাড়িয়া কামার হাসে। মায়ের দুঃখ গেল, বাপকে সোনার কুড়ুল গড়ে’ দিল; তখন রাজা শ্বশুর, রাণী শাশুড়ী, জামাই বেয়াইকে’ রাজ্য দিয়া; তপস্যায় গেলেন;-দেড় আঙ্গুলে’ পিপ্পল কুমার এক বেলা রাজ্য করে, এক বেলা বাপের সাথে কাঠ কাটে- খুট্-খুট্-খুট্!!