Golpo/Adda

Go Back
বিজ্ঞানের গল্প

 তথ্যপ্রযুক্তি  ছয় সাত বছর আগের কথা। আমি যুক্তরাষ্ট্রের বেল কমিউনিকেশান্স রিসার্চে একটা সার্কিট ডিজাইন করছি। সেখানে একটা আই.সি. ব্যবহার করব তাই আই.সি.-টার কোন পিন কোন কাজ করে জানা দরকার হয়ে পড়ল। আই.সি.র সেই তথ্যগুলো যে মোটা বইটাতে আছে সেটা আমার ঘরে শেলফের উপরের ব্যাকে। আমি দাঁড়িয়ে বইটি শেফ থেকে নামিয়ে সেটা খুলে আই.সি.টার তথ্যগুলো পেয়ে যেতে পারি কিন্তু আমি সেটি না করে অনেকটা অন্যমনস্কভাবে আমার সামনে রাখা কম্পিউটারে কিছু অক্ষর টাইপ করলাম। ইন্টারনেট ব্যবহার করে আই.সি.টার পিন আউট সংক্রান্ত তথ্য সরাসরি ডাইনলোড করে নিলাম। সার্কিট ডিজাইনে সেই তথ্যগুলো ব্যবহার করার সময় আমি হঠাৎ একটু চমকে উঠে নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কী করেছি? যে তথ্যটি আমার নাগালের ভেতরে, উঠে দাঁড়ালেই নেয়া যায় সেই তথ্যটি সেখান থেকে না নিয়ে আমি নিয়েছি হাজার হাজার মাইল দূরের কোনো এক সার্ভার থেকে? হাতের কাছে রাখা একটি বই থেকে তথ্য নেয়া আর কয়েক হাজার মাইল দূরের কোনো এক কোম্পানির সার্ভারের তথ্যভাণ্ডার থেকে তথ্য নেয়া এখন একই ব্যাপার? বলা যেতে পারে, এই ঘোট ঘটনাটির পর আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করেছিলাম যে–আমরা, পৃথিবীর মানুষেরা সভ্যতার একটি নূতন ধাপে এসে দাঁড়িয়েছি। তথ্যপ্রযুক্তি নামে যে কথাটি শুনতে শুনতে আমাদের সবার কানের পোকা নড়ে যাবার অবস্থা সত্যিই সেটি এসেছে এবং বলা যেতে পারে বিষয়টি পৃথিবীর সকল মানুষকে কোনো-না কোনোভাবে স্পর্শ করছে। তথ্যপ্রযুক্তি নামে পৃথিবীব্যাপী একটি নূতন ধরনের “বিপ্লব” এর পিছনে রয়েছে একটি যন্ত্র এবং এই যন্ত্রটির নাম কম্পিউটার। শুধু কম্পিউটারের কারণে এই বিপ্লবটি হয় নি, তার সাথে আরো যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়েছে, তবে কম্পিউটার বিষয়টি না থাকলে এটি ঘটতো না। কম্পিউটার নামটি এক সময় সম্ভবত যথাযথ ছিল কারণ এটি প্রথমে দাঁড়া করানো হয়েছিল হিসেব করার (comput) জন্যে। এখন এই যন্ত্রের এই নামটি আর যথাযথ নয় । কম্পিউটারের খুঁটিনাটির ভেতরে না গিয়ে বলা যায় এটি হচ্ছে একটা সহায়ক যন্ত্র (tool) বা টুল। ক্রু ড্রাইভার একটা টুল যেটা দিয়ে কোনো জায়গায় স্কু লাগানো যায় বা ঔ তুলে ফেলা যায়। ক্রু ড্রাইভার ছাড়া স্কু লাগানো বা তোলা খুব কঠিন, ঠিক উল্টোভাবে বলা যায় স্কু তোলা বা লাগানো ছাড়া ক্রু ড্রাইভার দিয়ে অন্য কোনো কাজ করা যায় না। এটা হচ্ছে টুলের বৈশিষ্ট্য, বিশেষ একটা কাজ করার জন্যে সেটা তৈরি হয় এবং সেই কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ সেটা করতে পারে না। সেই হিসেবে ঝাঁটা একটা টুল, চামচ একটা টুল। ঝাঁটার কাজ চামচ দিয়ে করা যাবে না, সে-রকম চামচের কাজও ঝাঁটা দিয়ে করা যাবে না। কম্পিউটার হচ্ছে একমাত্র টুল যেটা একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্যে তৈরি হয় নি। এটা দিয়ে কী কাজ করা যেতে পারে সেটা নির্ভর করে একজনের সৃজনশীতার উপরে। বলা হয়ে থাকে মানবসভ্যতার ইতিহাসে যে ছোট যন্ত্রটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করেছে সেটি হচ্ছে ভয়েজার 1 এবং 2 মহাকাশযান। পৃথিবী থেকে 1977 সালে শুরু করে সেটি একটি একটি গ্রহের পাশে দিয়ে গিয়েছে এবং সেই গ্রহটির পাশে দিয়ে যাবার সময় তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। ভয়েজার 1 এবং 2-এর পুরো নিয়ন্ত্রণে ছিল একটা কম্পিউটার, 1977-এর প্রযুক্তিতে সে-সময় যে কম্পিউটার তৈরি করা হয়েছিল সেটি বর্তমান কম্পিউটারের তুলনায় একটি হাস্যকর খেলনা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু সেই হাস্যকর খেলনা জাতীয় কম্পিউটারটি ভয়েজার 1 এবং 2 কে নিখুঁতভাবে গ্রহমণ্ডলীর ভেতর দিয়ে নিয়ে সৌরজগতের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই উদাহরণটি হচ্ছে সম্ভবতঃ কম্পিউটারের ব্যবহারের একটি সুন্দর উদাহরণ। খারাপ উদাহরণও আছে, কম্পিউটার ব্যবহার করে পৃথিবীতে আজকাল বড় বড় অপরাধ করা শুরু হয়েছে। ইলেকট্রনিক অর্থ বিনিময় শুরু হবার সাথে সাথে নিরাপত্তার জন্যে বিশেষ সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়ার প্রচলন হয়েছে। সংখ্যাটি যত বড় তার নিরাপত্তা তত বেশি। তবে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করার জন্যে বিশাল সংখ্যা এক ধরনের যন্ত্রণার মতো তাই সেই (PIN) নম্বরগুলো খুব বড় নয়। সাধারণভাবে সেটি অনুমান করা সহজ নয়, তাই অপরাধীরা কম্পিউটারকে বসিয়ে দেয় সেই নম্বরগুলোকে খুঁজে বের করতে। একজন মানুষের পক্ষে যেটা অসম্ভব একটা কম্পিউটারের জন্যে সেটা ছেলে-খেলা। তাই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের সেই গোপন নম্বর বের করে কোটি কোটি ডলার চুরি করা হচ্ছে। এটি হচ্ছে কম্পিউটার ব্যবহার করে অপকর্ম করার একটি উদাহরণ! কম্পিউটার ব্যবহারের প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছে এই দুটি উদাহরণের ভেতরে বাইরে আরো অসংখ্য উদাহরণ। এর শেষ কোথায় হবে সেটি অনুমান করা কঠিন, অনুমান করা যায় মানুষের সৃজনশীলতাই শুধু মাত্র এর শেষ খুঁজে বের করতে পারবে। তাই একটি সহায়ক যন্ত্র বা টুল হয়েও কম্পিউটার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভাগ ভোলা হয়, অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী সেটি নিয়ে পড়াশোনা করে। বিজ্ঞানী আর গবেষকরা তার উন্নতির জন্যে শ্রম দেন, ব্যবসায়ীরা সেটা ব্যবহার করে ব্যবসা করেন এবং সারা পৃথিবীর মানুষ সভ্যতাকে একটা নূতন পর্যায়ে হাজির হতে দেখেন। কোনো রকম খুঁটিনাটিতে না গিয়ে আমরা যদি কম্পিউটারকে ব্যাখ্যা করতে চাই তাহলে বলা যায় এর দুটি অংশ: একটি হচ্ছে প্রসেসর অন্যটি মেমোরি। প্রসেসরে হিসেব-নিকেশ করা হয়, মেমোরিতে তথ্যগুলোকে সাময়িকভাবে রাখা যায়। প্রথম কম্পিউটার তৈরি হবার পর যতদিন যাচ্ছে ততই একদিকে প্রসেসরের উন্নতি হচ্ছে অন্যদিকে একটি প্রসেসরের সাথে অনেক বেশি মেমোরি যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ার কারণে সুফলটা সরাসরি ভোগ করছে কম্পিউটার প্রযুক্তি এবং মোটামুটিভাবে বলা যায় প্রতি কয়েক বছরেই কম্পিউটারের ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির অন্য কোনো ক্ষেত্রে এরকম উন্নতি দেখা গিয়েছে কেউ দাবি করতে পারবে না। এই বিষয়টি মানুষকে হঠাৎ একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। মানুষের মস্তিষ্ক এবং কম্পিউটারের কর্মপদ্ধতি এক নয়। কম্পিউটার কাজ করে ডিজিটাল সিগনাল দিয়ে, এখানে প্রসেসর আর মেমোরি দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। মানুষের মস্তিষ্কের সংযোগকে বলা হয় নিউরাল সংযোগ, সেখানে প্রসেসর আর মেমোরী একই জায়গায়। তারপরেও বিজ্ঞানীরা হিসেব করে মানব মস্তিষ্ককে কম্পিউটারের সাথে তুলনা করার চেষ্টা করেন এবং আমাদের পরিচিত কম্পিউটারকে মানুষের মস্তিষ্কের সমান ক্ষমতায় পৌঁছুতে কতদিন লাগতে পারে সেটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে থাকেন। কম্পিউটারের ক্ষমতা যে হারে বাড়ছে সেটি দেখে অনুমান করা হয় আমরা আমাদের জীবদ্দশাতেই সে ধরনের একটি কম্পিউটার দেখতে পাব। তারপরের প্রশ্নটি গুরুতর, সত্যি সত্যি যদি সেরকম কিছু তৈরি হয়ে যায় তাহলে কী সেখানে মানুষের ভাবনা-চিন্তা বা অস্তিত্বের একটা বীজ বপন করা যাবে? বিজ্ঞানীরা সে ব্যাপারে এখনো দ্বিধাভিভক্ত। কেউ কেউ বলেন যাবে, কেউ কেউ বলেন যাবে না! আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ বংশধর হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন। তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটারের ভূমিকা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। কম্পিউটার বলতেই আমাদের চোখের সামনে যে মনিটর, কী বোর্ড বা সি.পি.ইউ এর ছবি ভেসে উঠে সেটা তার একমাত্র রূপ নয়। ক্যামেরা বা মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে গাড়ি জাহাজ বা প্লেন প্রযুক্তির এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এটি জায়গা করে নেয় নি। যে বিষয়টি একসময় প্রায় অসম্ভব একটি বিষয় ছিল এখন সেটি সহজ একটি ব্যাপার। পৃথিবীর সকল কম্পিউটারকে যুক্ত করে কম্পিউটারের একটা বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। এই নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে অনেক কিছু করা সম্ভব তার সব আমরা এখনো দেখি নি। যেটি দেখে আমরা সবাই অভ্যস্ত সেটাকে ইন্টারনেট বলি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা নূতন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে বলতে হলে ইন্টারনেট হবে তার একটি। ইন্টারনেট তার প্রাথমিক নতুনত্বের উত্তেজনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, আগামী দশকের ভেতর তার নতুনত্বটুকু ফুরিয়ে যাবার পর আমরা যে তার স্থায়ী ভূমিকাটি দেখতে পাব সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মানবসভ্যতায় সেটি কী অবদান রাখবে সেটি দেখার জন্য পৃথিবীর মানুষ কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে। পৃথিবীর বড় বড় মনীষীরা পৃথিবীর সকল মানুষের সমান অধিকারের জন্যে সংগ্রাম করে গেছেন। আমরা ধারণা তারা যদি এখন পৃথিবীতে ফিরে আসতেন তাহলে ইন্টারনেট দেখে খানিকটা সান্ত্বনা পেতেন। পৃথিবীর অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, অনেক রাষ্ট্রনায়ক, অনেক দার্শনিক যেটি করতে পারেন নি পৃথিবীর বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদেরা সেটা করে ফেলেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী মানুষের কাছে এখন যে তথ্যভাণ্ডার পৃথিবীর সবচেয়ে সাধারণ মানুষের কাছেও এখন সেই তথ্যভাণ্ডার। পৃথিবীর খুব সাধারণ একজন মানুষও এখন তার প্রতিবাদ, তার ক্ষোভ বা আনন্দকে এখন সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে তুলে দিতে পারে। পৃথিবীর মানুষের এত ক্ষমতার কথা কি কেউ কখনও চিন্তা করেছিল? নূতন কিছু নিয়ে উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক বিষয়। তথ্য প্রযুক্তি নিয়েও সেটা হয়েছে। ভোগবাদী মানুষ এর সাথে জড়িত। অর্থবিত্তকে নিয়ে প্রয়োজন থেকে বেশি মাথা ঘামিয়েছে। যে বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদেরা এটাকে গড়ে তুলেছে তাদেরকে যথাযথ সম্মান না দিয়ে যারা এটাকে নিয়ে ব্যবসা করেছে সে-রকম মানুষকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছে। কিন্তু এই সকল উচ্ছ্বাস একসময় কমে আসবে, চোখ ধাঁধানো অর্থবিত্তের কুয়াশা কেটে যাবার পর আমরা তথ্যপ্রযুক্তির সত্যিকার রূপটি দেখতে পাব। সেটা দেখার জন্যেই পৃথিবীর অনেক মানুষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। সেটি কী কেউ জানে না। আমার ধারণা সেই ভূমিকাটি হবে পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে তার অবদানটুকু পৃথিবীর ইতিহাস সেটি আগে কখনো ঘটে নি। অজানাকে জানার জন্যে মানুষের হাতে এখন যে বিশাল অস্ত্র আছে তার কথা কী কেউ কখনও কল্পনা করতে পারেছিল? . 7. ফাইবার অপটিক্স “ফাইবার অপটিক্স” বিষয়টি কী ভালোভাবে না জানলেও আমাদের দেশের মানুষ “ফাইবার অপটিক্স” কথাটির সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই ফাইবার অপটিক ক্যাবল দিয়ে আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রবাহের মূলধারার সাথে বহুদিন আগে যোগাযোগ করে ফেলেছে, সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করে সেই যোগাযোগটি করতে আমদের বহুকাল লেগে গেছে। যখন বিষয়টি খুব সহজ ছিল তখন সরকারি নির্বুদ্ধিতার কারণে সেটা নেয়া হয় নি। গত এক দশক থেকে দেশের মানুষের চাপে সরকার “নিচ্ছি” “নেবো” করছে, শুনে শুনে আমরা কখনো ক্লান্ত, কখনো হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত সেই যোগাযোগটি হয়েছে এখনো সেটি বিশ্বাস হতে চায় না। আমাদের দেশের ইন্টারনেট যোগাযোগ হতো ভিস্যাট দিয়ে। সারা দেশে হয়তো শ খানেক ভিস্যাট ছিল অথচ এখন একটি অপটিক্যাল ফাইবার দিয়েই লাখ খানেক ভিস্যাটের সমান তথ্যবিনিময় করা যেতে পারে, তাই আমরা সবাই যে ফাইবার অপটিক্স নিয়ে একটু অস্থির হয়েছিলাম তাতে অবাক হবার কী আছে? ফাইবার শব্দটির অর্থ তন্ত্র এবং অপটিক্স হচ্ছে আলোসংক্রান্ত বিজ্ঞান, কাজেই ফাইবার অপটিক্স কথাটি দিয়ে কোনো সূক্ষ্ম তন্তু দিয়ে আলো আনা নেয়ার বিজ্ঞানকে বোঝানোর কথা। তবে সাধারণ অর্থে আমরা ফাইবার অপটিক্স বলতে কাচের সূক্ষ্ম তন্তু দিয়ে তথ্য পাঠানোর প্রযুক্তিটিকে বুঝিয়ে থাকি। তথ্য আদান প্রদানের অন্যান্য পদ্ধতি থেকে এটা ভিন্ন কারণ এখানে সেই কাজটি করার জন্যে আলো ব্যবহার করা হয়। আলো ব্যবহার করে তথ্য পাঠানো খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। মাত্র কিছুদিন আগে এক রাতের ট্রেনে আমি একজন স্মাগলারকে দেখেছি, সে তার হাতের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে এবং নিভিয়ে তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের একটা সংবাদ দিল! ফাইবার অপটিক্স ব্যবহার করে তথ্য পাঠানোর মূল বিষয়টা অনেকটা সেরকম–আলো জ্বালিয়ে এবং নিভিয়ে তথ্য পাঠানো। তবে সেটা করা হয় অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। স্মাগলার যেখানে তার আলোটা সেকেন্ডে একবার জ্বালাতে বা নেভাতে পারে ফাইবার অপটিক্সের লেজার রশ্মি সেটা করে সেকেন্ডে হাজার কোটি বার থেকে বেশি (দশ বিলিওন)! স্মাগলারের টর্চ লাইটের আলো যায় সোজা, সামনে দেয়াল থাকলে সেই আলো আটকে যায়, দেয়াল ভেদ করে যেতে পারে না। ফাইবার অপটিক্সে সেটা যায় সূক্ষ্ম কাচের তন্তু দিয়ে, সেই কাচের তন্তু দেয়ালে ঘরবাড়ি এমনকি সমুদ্র মহাসমুদ্র পর্যন্ত পাড়ি দিতে পারে। তথ্য পাঠানোর এই প্রক্রিয়ায় যে সূক্ষ্ম কাচের তন্তু ব্যবহার করা হয় তাকে বলে অপটিক্যাল ফাইবার। যে বিজ্ঞানী প্রথম অনুমান করেছিলেন তথ্য পাঠানোর জন্যে কাচের তন্তু বা অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করা যেতে পারে নিঃসন্দেহ তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। জানালার বা ছবির ফ্রেমে কাচ দেখে আমরা ধারণা করেছি কাছ একটি স্বচ্ছ জিনিস, সেটি স্বচ্ছ তার কারণ কাঁচটি পাতলা। আমরা যদি কাচের একটা দণ্ড নিই তাহলে আবিষ্কার করব কাচ আসলে তেমন স্বচ্ছ নয়। সাধারণ কাচের ভেতর দিয়ে আলো পাঠালে মাত্র বিশ মিটার যেতে যেতেই তার শতকরা নিরানব্বই ভাগ শোষিত হয়ে যায়। এ-রকম একটা জিনিস দিয়ে একদিন শত শত কিলোমিটার দূরে তথ্য পাঠানো যেতে পারে বিষয়টি আগে থেকে অনুমান করতে পারেন শুধু সত্যিকারের একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। তথ্য পাঠানোর জন্যে কাচের স্বচ্ছতা বাড়ানোর কাজে বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদরা কাজ শুরু করে একটা অভাবনীয় কাজ করে ফেললেন। তারা কাঁচকে এমনই স্বচ্ছ করে ফেললেন যে আলোর শতকরা নিরানব্বই ভাগ শোষিত হওয়ার জন্যে বিশ মিটার নয় এখন যেতে হয় দুইশ’ কিলোমিটার। মানুষ কোন কিছুকে একগুণ বা দ্বিগুণ উন্নত করতে পারলেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। সেই হিসেবে এই উন্নতি হচ্ছে দশ হাজার গুণ! পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। কাঁচকে স্বচ্ছ করার পর তার ভেতর দিয়ে আলো পাঠানোর আগে আরো একটা প্রশ্ন এসে যায় সেটা হচ্ছে এই স্বচ্ছ কাচের ভেতর আলো আটকা থাকবে কেন? আলো তো সরল রেখায় যায় কাচের তন্তু একটু বাকা হলেই তো আলো কাচের দেয়ালে এসে আঘাত করে বের হয়ে যাবে। আলোকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে হলে তাকে তো কাচের তন্তুর ভেতরে আটকে রাখতে হবে, সেটা করা হবে কেমন করে? আসলে এই ব্যাপারটি খুব কঠিন নয়, পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন নামে একটা প্রক্রিয়া এই কাজটিকে খুব সহজ করে দিয়েছে। বিষয়টি 7.2 নং ছবিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যাবার সময় আলো বেঁকে যায়। 7.2 নং ছবির প্রথম অংশে সেটা দেখানো হয়েছে কাচ এবং বাতাসের জন্যে। খানিকটা কাচ ভেদ করে বাতাসে চলে গেছে এবং খানিকটা প্রতিফলিত হয়ে কাচের ভেতরেই ফিরে এসেছে। এখন কোনোভাবে যদি আলোকরশ্মিটা আরো বাঁকা করে পাঠানো যায় তাহলে দেখা যাবে একটা নির্দিষ্ট কোণ থেকে বেশি হলে কোনো আলোই আর কাচ ভেদ করে বাতাসে যেতে পারছে না, পুরোটাই কাচের ভিতরে ফিরে আসছে। ঘন মাধ্যমে থেকে হালকা মাধ্যমে যাবার সময় আলো যখন বের হতে না পেরে পুরোটাই প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে সেটাকে বলে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন। অপটিক্যাল ফাইবারে আলো আটকা পড়ে থাকে এই কারণে, অস্বাভাবিক স্বচ্ছ হওয়ার পরেও আলো বের হতে পারে না। অপটিক্যাল ফাইবারে আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনকে ব্যবহার করার জন্যে সেটাকে খুব সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা হয়। অনেকেই হয়তো জানে না যে অপটিক্যাল ফাইবার আসলে চুল থেকেও সূক্ষ্ম! এছু সূক্ষ্ম কাচ অত্যন্ত ভঙ্গুর বলে তার উপরে প্লাস্টিকের একটা আবরণ থাকে এরং সে কারণে সেটাকে হয়তো সুতোর মতো মোটা দেখায়। তবে সেটাকে ব্যবহার করার জন্যে তার উপরে আরো নানারকম আবরণ দেয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত সেটা টেবিল ল্যাম্পের ইলেকট্রিক তারের মতো আকার নেয়। মাটির নিচে দিয়ে বা সমুদ্রের নিচে দিয়ে যে অপটিক্যাল ফাইবার নেয়া হয় সেগুলো অবশ্যি রীতিমতো রাক্ষুসে ক্যাবল। তার ভিতরে বাইরে নানা ধরনের আবরণ থাকে, পুরো ক্যাবলটাকে শক্ত করার জন্যে ভেতরে শক্ত স্টীলের পাত পর্যন্ত ঢুকিয়ে রাখা হয়। ফাইবার অপটিক্সে যে কাচের তন্তু ব্যবহার করা হয় তার দুটি অংশ। ভেতরের অংশটি কার বা কেন্দ্র এবং বাইরের অংশটি ক্ল্যাড বা বহিরাচ্ছাদন। আলো যেন পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন হয়ে অপটিক্যাল ফাইবার আটকা থাকতে পারে সে জন্যে সব সময়েই ক্ল্যাড থেকে কোরের প্রতিসারংকে বেশি হয়। তথ্যবিনিময় করার জন্যে ফাইবার অপটিক্স কমিউনিকেশান্সে দুই রকম ফাইবার ব্যবহার করা হয়। এক ধরনের ফাইবারের কোর হচ্ছে 50 মাইক্রন তার নাম মাল্টিমোড ফাইবার। অন্য আরেক ধরনের ফাইবারের কোর আরো অনেক ছোট, 10 মাইক্রনের কাছাকাছি, তার নাম সিংগল মোড ফাইবার। কোরের বাইরে ক্লাডের আচ্ছাদন দিয়ে দুই ধরনের ফাইবারকেই 125 মাইক্রনের কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছে। 7.4 নং ছবিতে এই দুই ধরনের ফাইবারকে দেখানো হয়েছে। মাল্টিমোড ফাইবারে আলোকরশ্মি নানাভাবে যেতে। পারে কিন্তু সিংগল মোড ফাইবারে সেটি যেতে পারে মাত্র এক ভাবে, ফাইবারগুলোর নামকরণটি হয়েছেও এই কারণে। যদি দীর্ঘ দূরত্বে যেতে হয় এবং তথ্যবিনিময় করতে হয় অনেক বেশি তাহলে সব সময়েই সিংগল মোড ফাইবার ব্যবহার করতে হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের ফাইবারগুলো সিংগল মোড। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যে সাবমেরিন ক্যাবল বাংলাদেশে আসছে সেটিও সিংগল মোড। সিংগল মোডের, আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি জটিল তার খরচও বেশি। যদি ছোট খাট দূরত্বে যেতে হয় তাহলে মাল্টিমোড ফাইবার ব্যবহার করা যায়। আমাদের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেটওয়ার্ক তৈরি করার সময় মাল্টিমোড ফাইবার ব্যবহার করা হয়েছে, ক্যাম্পাস ছোট বলে দূরত্ব বেশি নয়–সেটি একটি কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলে অর্থের টানাটানি –সেটি আরেকটি কারণ। এতক্ষণ আমরা শুধু কাচের তন্তু বা অপটিক্যাল ফাইবারের কথা বলেছি, এর ভেতর দিয়ে কী ধরনের আলো পাঠানো হয় সেটি নিয়ে কোনো কথা বলি নি। যেহেতু আলোর কথা বলা হচ্ছে একটা খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন আলোর রংটা কী? লাল নীল হলুদ নাকি অন্য কিছু? মজার ব্যাপার হচ্ছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তার কারণ ফাইবার অপটিক কমিউনিকেশান্সে যে আলো ব্যবহার করা হয় সেটি দৃশ্যমান আলো নয়, আমরা যেটা চোখেই দেখতে পাই না সেটার আবার রং কীভাবে হবে? ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করে বলা যায়। আলো আসলে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। যে কোন তরঙ্গের একটা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থাকে কাজেই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গেরও তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আছে। এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট করা নেই, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে শুরু করে কয়েকশ কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের তরঙ্গ-দৈঘ্য যখন 0.4 থেকে 0.7 মাইক্রনের ভেতর হয় শুধু মাত্র তখন আমরা সেটা দেখতে পাই, অন্য কখনো দেখতে পাই না। 7.5 নং ছবিতে বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের জন্যে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গকে কী নামে ডাকা হয় সেটা দেখানো হয়েছে। দৃশ্যমান আলোর পাশে যে ইনফ্রারেড আলো রয়েছে সেটি ফাইবার অপটিক কমিউনিকেশান্সে ব্যবহার করা হয়। ইনফ্রারেড আলোর ব্যাপ্তি বেশ বড়, তার পুরোটুকু ব্যবহার করা যায় না, তরঙ্গ দৈর্ঘ্য 1.3 থেকে 1.5 মাইক্রন পর্যন্ত ছোট অংশটাকে ব্যবহার করা হয়। ফাইবার অপটিক্স কমিউনিকেশান্সে ইনফ্রারেড আলোটা দেয়া হয় লেজার দিয়ে। সত্তরের দশকে লেজারের প্রযুক্তিটি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। একদিন লেজার অন্যদিকে ফাইবার এই দুটি প্রযুক্তি একই সাথে গড়ে উঠে পৃথিবীকে তথ্য আদান প্রদানের যে দরজাটি খুলে দিয়েছে প্রযুক্তির ইতিহাসে সেটি সব সময় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। আর সেই ভোলা দরজা দিয়ে সম্ভাবনার যে আলো এসে পরেছে পৃথিবীকে সেটি সারা জীবনের জন্যে পাল্টে দিয়েছে।