লাদাখ
লাদাখ (তিব্বতি: ལ་དྭགས) উত্তরে কুনলুন পর্বতশ্রেণী এবং দক্ষিণে হিমালয় দ্বারা বেষ্টিত ভারতের একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল।এই এলাকার অধিবাসীরা ইন্দো-আর্য এবং তিব্বতী বংশোদ্ভুত। ঐতিহাসিককাল ধরে বালটিস্তান উপত্যকা, সিন্ধু নদ উপত্যকা, জাংস্কার, লাহুল ও স্পিটি, রুদোক ও গুজ সহ আকসাই চিন এবং নুব্রা উপত্যকা লাদাখের অংশ ছিল। বর্তমানে লাদাখ শুধুমাত্র লেহ জেলা ও কার্গিল জেলা নিয়ে গঠিত।
প্রাচীন ইতিহাস:
লাদাখের বিভিন্ন অংশে প্রাপ্ত খোদিত প্রস্তরখন্ড থেকে জানা যায় যে নব্য প্রস্তর যুগেও এই অঞ্চলে মানুষের বসবাস ছিল।এই অঞ্চলের প্রথমদিককার অধিবাসীদের মধ্যে মিশ্র ইন্দো-আর্য মোন ও দর্দ জাতির মানুষ ছিলেন। হিরোডোটাস গান্দারিওই এবং জারেক্সেসের গ্রীস আক্রমণের উল্লেখ করার সময় দাদিকাই নামে এক জাতির উল্লেখ করেন। মেগাস্থিনিস ও নিয়ার্কোস ও প্রথম শতাব্দীতে প্লিনি স্বর্ণ প্রস্তুতকারক দর্দ জাতির উল্লেখ করেছেন। টলেমি সিন্ধু নদ উপত্যকার উপরের অংশে দারাদাই নামক জাতির উল্লেখ করেন। কা-লা-র্ৎসে বা খালাতসের নিকটে প্রাপ্ত উভিমা কভথিসার খরোষ্ঠী লিপি থেকে জানা যায়, প্রথম শতাব্দীতে লাদাখ কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল!
৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বৌদ্ধ পরিব্রাজক হিউয়েন সাং চুলুডুয়ো বা কুলু থেকে লুয়োহুলুয়ো বা লাহুল পর্যন্ত এক যাত্রার উল্লেখ করে বলেন যে চুলুডুয়ো থেকে এক হাজার আটশো বা নয়শো লি উত্তরে পর্বত ও উপত্যকার কঠিন পথ ধরে গেলে লুয়োহুলুয়ো দেশে পৌছানো যায়। সেখান থেকে আরো দুই হাজার লি উত্তরে কঠিন বাঁধার মধ্যে দিয়ে শীতল ঝড় ও তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে গেলে মার-সা দেশে যাওয়া যায়" এই মার-সা বা মো-লো-সো লাদাখের অপর নাম মার্যুলের সঙ্গে সমার্থক। এই ভ্রমণ রচনা থেকে জানা যায় যে এই মো-লো-সো সুবর্ণগোত্র রাজ্যের পার্শ্ববর্তী রাজ্য। গ্যুসেপ তুচ্চির মতে সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতীয়দের কাছে ঝাংঝুং বা তার দক্ষিণ অংশ সুবর্ণগোত্র বা সুবর্ণভূমি বা স্ত্রীরাজ্য নামে পরিচিত ছিল ।
অষ্টম শতাব্দীতে লাদাখে পশ্চিম দিক থেকে তিব্বতের ও মধ্য এশিয়া থেকে চীনের আধিপত্য বিস্তার শুরু হয়। ৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বত ব্রু-জা বা গিলগিট আক্রমণ করলে সেখানকার রাজা চীনের সহায়তা প্রার্থনা করেন কিন্তু পরবর্তীকালে তিব্বতকে কর প্রদানে বাধ্য হন। কোরীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হায়েচো ভারত থেকে মধ্য এশিয়ার পথে চীন যাওয়ার পথে কাশ্মীরের উত্তর পূর্বে অবস্থিত তিনটি রাজ্য সম্বন্ধে তার ভ্রমণ কাহিনী ওয়াং ওচেওনচুকগুক জেওন গ্রন্থে বলেন যে এই রাজ্যগুলি তিব্বতের শাসনাধীনে থাকলেও বৌদ্ধমঠ ও বুদ্ধের শিক্ষার কোন অস্তিত্ব সেখানে ছিল না। রিজভির মতে এই উক্তি প্রমাণ করে যে অষ্টম শতাব্দীর শুরুর দিকে লাদাখ তিব্বতের অধীনে থাকলেও সেখানকার মানুষ তিব্বতী ছিলেন না।
৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে চীনের সেনাপতি গাও জিয়ানঝি মধ্য এশিয়া ও কাশ্মীরের মধ্যে যোগাযোগের রাস্তা খোলার চেষ্টা করলে লাদাখ অঞ্চলে তিব্বতের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পায়। কিন্তু ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে তালাস নদীর তীরে আরবদের বিরুদ্ধে গাও পরাজিত হলে তিব্বতের প্রভাব ফিরে আসে।
প্রথম পশ্চিম তিব্বত রাজবংশ:
১০০০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোনের আমলে লাদাখ রাজ্যে বিস্তার
৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বত সাম্রাজ্যের পতন হলে অন্তিম তিব্বত সম্রাট গ্লাং-দার-মার পৌত্র স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোন প্রথমবার লাদাখে রাজবংশ তৈরী করেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে সম্পাদিত লা-দ্ভাগ্স-র্গ্যাল-রাব্স বা লাদাখের রাজাদের ধারাবিবরণীতে বলা হয় যে রাজা স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোন তার তিন পুত্রের মধ্য তার সাম্রাজ্য ভাগ করে দেন। এই বিবরণীতে বলা হয় তিনি তার তার জ্যৈষ্ঠ পুত্র দ্পাল-গ্যি-ঙ্গোনকে মার্যুল, হ্গোগের স্বর্ন খনি, রু-থোগ, ল্দে-ম্চোগ-দ্কার-পো ও রা-বা-দ্মার-পো প্রদান করেন। এই বিবরণী থেকে বোঝা যায় যে, রু-থোগ বা রুদোক এবং ল্দে-ম্চোগ-দ্কার-পো বা দেমচোক মার্যুল বা লাদাখের অংশ ছিল। এই সময়ে লাদাখ সম্পূর্ণ রূপে তিব্বতী সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এর ফলে লাদাখে তিব্বতী জনসংখ্যা বেড়ে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়। এই সময়ে লাদাখের নতুন রাজবংশ কাশ্মীর ও উত্তর পশ্চিম ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তারে সচেষ্ট হন। ৮৭০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকারী ল্দে-দ্পাল-হ্খোর-ব্ৎসান লাদাখ অঞ্চলে বোন ধর্ম বিস্তারের উদ্দেশ্যে আটটি মঠ তৈরী করেন। ন্যিমা-গোনের বংশের বাকি রাজাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এই রাজ্যের পঞ্চম রাজা ল্হাচেন উৎপল কুলু, মুস্তাং ও বালটিস্তানের কিছু অংশ জয় করেন।
নামগ্যাল রাজবংশ:
সেংগে নামগ্যাল দ্বারা নির্মিত লেহ প্রাসাদ
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইসলামের ভারত বিজয়ের সময়কাল থেকে লাদাখ তিব্বতের কাছ থেকে ধর্মীয় পথপ্রদর্শনের সহায়তা নিতে থাকে। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী মুসলিম রাজ্যগুলি বহুবার লাদাখ আক্রমণ করলে কিছু লাদাখি নূরবকশিয়া ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন।এই সব কারণে লাদাখ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বাসগো ও তেমিসগাম থেকে রাজা তাকপাবুম উত্তর লাদাখ ও লেহ ও শে থেকে রাজা তাকবুমদে নিম্ন লাদাখ শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। ১৪৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাসগোর রাজা ল্হাচেন ভগন লেহর রাজাকে পরাজিত করে লাদাখকে এক রাজ্যে পরিণত করেন। তিনি নামগ্যাল বা বিজয়ী উপাধি ধারণ করে নামগ্যাল রাজবংশ স্থাপন করেন। ১৫৫৫ থেকে ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকারী রাজা তাশি নামগ্যাল মধ্য এশিয়ার আক্রমণকারীদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। সেওয়াং নামগ্যাল তার রাজ্য নেপাল পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।রাজা জাম্যাং নামগ্যালের আমলে মুসলমান্দের দ্বারা প্রচুর বৌদ্ধ পুরাকীর্তি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। ১৬১৬ থেকে ১৬৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকারী রাজা সেংগে নামগ্যাল মুসলমানদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হেমিস বৌদ্ধবিহার সহ বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার ও কারুকীর্তিগুলির পুনর্নির্মাণ করে লাদাখের পুরাতন গৌরব ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। তিনি তার রাজপ্রাসাদ শে প্রাসাদ থেকে নবনির্মিত লেহ প্রাসাদে সরিয়ে আনেন। তার আমলে লাদাখের সীমানা জাংস্কার ও স্পিটি পর্যন্ত প্রসারিত হয়, কিন্তু মুঘলদের কাছে তিনি পরাজিত হন।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিব্বতের সাথে ভূটানের দ্বন্দ্ব শুরু হলে লাদাখ ভূটানের পক্ষ নেয়। এর ফলে তিব্বত লাদাখ আক্রমণ করলে ১৬৭৯ থেকে ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিব্বত-লাদাখ-মুঘল যুদ্ধ হয়।এই যুদ্ধে ফিদাই খাঁর নেতৃত্বে মুঘল অধিকৃত কাশ্মীর লাদাখকে সহায়তার বিনিময়ে লেহ শহরে মসজিদ নির্মাণ ও লাদাখের রাজা দেলদান নামগ্যালকে ইসলাম ধর্মগ্রহণের শর্ত রাখে।ফিদাই খাঁ পঞ্চম দলাই লামাকে চারগ্যালের সমতলভূমিতে পরাজিত করার পর ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দে টিংমোসগাংয়ের চুক্তিতে লাদাখ ও তিব্বতের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান হলেও লাদাখের স্বাধীনতা এতে অনেকাংশে খর্ব হয়।
১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে লাদাখের রাজা সেপাল নামগ্যালের সামন্ত টিম্বুসের রাজা লাদাখের বিরুদ্ধে ডোগরা সেনাপতি জোরাওয়ার সিং কাহলুরিয়ার সাহায্য চাইলে তিনি লাদাখের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। প্রথমেই তার ৫০০০ সৈন্য সুরু নদীর তীরে ঐ অঞ্চলের বোটি সৈন্যদের পরাজিত করে। এরপর তিনি কার্গিলের পথে সামন্ত রাজাদের পরাজিত করা শুরু করলে লাদাখের রাজা সেপাল নামগ্যাল তার সেনাপতি বাঙ্কো কাহ্লোনকে জোরাওয়ারের রসদ সংগ্রগের পথটি নষ্ট করতে পাঠান। কিন্তু তীক্ষ্ণবদ্ধির অধিকারী জোরাওয়ার শীতের শুরুতে কার্ৎসে ফিরে আসেন এবং সেখানেই সৈন্যদের নিয়ে শীতকাল কাটান। পরের বছর বসন্তকালে তিনি বাঙ্কো কাহ্লোনের সৈন্যদলকে পরাজিত করে লেহ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। সেপাল নামগ্যাল যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫০,০০০ টাকা ও বার্ষিক ২০,০০০ টাকা কর দিতে সম্মত হন। এরপর লাদাখের সামন্তরা জোরাওয়ারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে জোরাওয়ার পুনরায় হিমালয় অতিক্রম করে এই বিদ্রোহ দমন করেন। এই অভিযানে তিনি জাংস্কারের রাজাকে কর প্রদানে বাধ্য করেন। ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে সেপাল নামগ্যাল জোরাওয়ারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে জোরাওয়ার দশদিনে লাদাখ পৌছে বিদ্রোহ দমন করেন। এই বার তিনি লেহতে এক দুর্গ তৈরী করেন এবং দলেল সিংয়ের অধীনে তিনশ সৈন্য রেখে যান। সেপাল নামগ্যালকে সরিয়ে এক লাদাখি সেনাপতি ঙ্গোরুব স্তাঞ্জিনকে লাদাখের রাজার সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে যান। কিন্তু ঙ্গোরুব তার আনুগত্যে অস্বীকার করলে ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সেপাল নামগ্যাল পুনরায় লাদাখের রাজা হিসেবে বহাল হন। ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বত আক্রমণ কালে জোরাওয়ারের মৃত্যু হলে শেষ বারের মতো লাদাখীরা বিদ্রোহ করলে ডোগরারা দ্রুত এই বিদ্রোহ দমন করে তিব্বতীদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। এই ঘটনার পর নামগ্যাল রাজবংশের রাজনৈতিক প্রভাব লাদাখ থেকে লোপ পায় এবং সিন্ধু নদের তীরে স্তোক গ্রামে এক প্রাসাদে বসবাস করতে বাধ্য হয়।
ব্রিটিশ প্রভাব বিস্তার সম্পাদনা
নামগ্যাল রাজবংশের পতনের পর লাদাখ কাশ্মীরের অন্তর্গত হয়। ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে আলেকজান্ডার কানিংহাম লাদাখ ও তিব্বতের মধ্যে সীমান্ত সমীক্ষার চেষ্টা করে কাশ্মীর ও তিব্বতের শাসকদের অসহযোগিতার জন্য ব্যর্থ হন। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে পরিব্রাজক রবার্ট শ এবং লাদাখের উজীর ফ্রেডেরীখ ড্রীউ পুনরায় এই সমীক্ষা করেন।২১৭-২৩৪ ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারত সরকার হেনরী কেইলীকে লাদাখ অঞ্চলের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ও গুপ্তসংবাদ আহরণের জন্য লেহ পাঠান। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারত সরকার কাশ্মীর রাজ্যের সাথে এক চুক্তির ভিত্তিতে লেহ শহরে এক ব্রিটিশ যুগ্ম কমিশনার পদের সৃষ্টি করে লাদাখের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার বহির্বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কাশ্মীরের সঙ্গে পূর্ব তুর্কিস্তানের বৈদেশিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
লাদাখ এ আজও কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে।