Golpo/Adda

Go Back
রহস্যময় গল্প

ইলুমিনাতি। নামটার সাথে পরিচিত নয় এমন পাঠক পাওয়া যাবে না। যেখানেই আছে রহস্য কিংবা চক্রান্তের গন্ধ সেখানেই যেন ইলুমিনাতিকে খুঁজে পায় অনেকে। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আর ইলুমিনাতি যেন একই মুদ্রার দুটো পিঠ। কিন্তু কী এই ইলুমিনাতি? কীভাবেই বা তারা এলো? কতটুকই বা কঠিন বাস্তব আর কতটুকুই বা কল্পনা? চলুন ঘুরে আসি এই সিক্রেট সোসাইটির জগৎ থেকে! Angels & Demons বইতে ইলুমিনাতির কল্পিত অ্যাম্বিগ্রাম ঘটনার শুরু বলা চলে জার্মানির দক্ষিণপূর্বের রাজ্য ব্যাভারিয়াতে। ব্যাভারিয়া আবার জার্মানির বৃহত্তম রাজ্য (যার রাজধানী মিউনিখ)। সেখানের ইঙ্গলস্ট্যাড ইউনিভার্সিটির খ্রিস্টীয় আইন ও ব্যবহারিক দর্শনবিদ্যার প্রফেসর ছিলেন অ্যাডাম ওয়েইশপ্ট [Adam Weishaupt] (1748–1830)। ইউনিভার্সিটি তখন সম্পূর্ণই জেসুইট প্রভাবে, অর্থাৎ পুরোই খ্রিস্টীয় আইনকানুন মেনে চলে। যে কেউ যার কিনা খ্রিস্টধর্মের প্রতি আনুগত্য কিছুটা কম তাকেই পোহাতে হত নানা সমস্যা। অ্যাডাম তখন চিন্তা করলেন এমন এক গুপ্ত সংঘের যার মাধ্যমে তিনি “আলোকায়ন” (এনলাইটেনমেন্ট) করতে পারবেন। আর এ গুপ্ত সংঘের সদস্য হবেন একদম চূড়ান্ত পর্যায়ের যারা বুদ্ধিজীবী, তাঁরাই। ম্যাপে জার্মানির ব্যাভারিয়া তখন কিন্তু আরেক গুপ্ত সংঘ ইতোমধ্যে ছিল, যার নাম ফ্রিমেসনরি। [ফ্রিমেসনদের নিয়ে কথা হবে আরেক পর্বে, আশা রাখি।] কিন্তু অ্যাডাম দেখলেন ফ্রিমেসনদের সাথে যোগ দেয়াটা অনেক খরচের ব্যাপার। তাছাড়া তার নিজের ধ্যানধারণার সাথে তেমন যায়ও না। তাই তিনি নিজের ধ্যানধারণা মোতাবেক এক সংঘ খুলে বসার পরিকল্পনা করলেন, আর তাতে থাকবে ফ্রিমেসনদের মতন ধাপে ধাপে উর্ধ্ব র‍্যাংকিং এ উঠবার সিস্টেম থাকবে। অ্যাডাম ওয়েইশপ্ট [Adam Weishaupt] (1748–1830) প্রথমে তিনি তার সংঘের নাম রাখলেন “Bund der Perfektibilisten”, or “Covenant of Perfectibility”; কিন্তু এই কিম্ভূতকিমাকার নাম তার নিজেরই পছন্দ হলো না। মে মাসের ১ তারিখ। সালটা ১৭৭৬। সেদিন অ্যাডাম আর তার চার ছাত্র মিলে এই সংঘ শুরু করলেন। আর সংঘের প্রতীক হলো গ্রিক জ্ঞানদেবী মিনারভার পেঁচা। মিনারভার পেঁচা- ইলুমিনাতির প্রথম লোগো অ্যাডাম সদস্যদের জন্য ছদ্মনামের ব্যবস্থা করলেন। অ্যাডামের নিজের নাম হলো স্পার্টাকাস। তার ছাত্র Massenhausen এর নাম হলো অ্যাজাক্স, Merz এর নাম হলো অ্যাগাথন আর Sutor এর নাম হলো ইরাসমাস রোটারোডেইমাস। কিন্তু Sutor-কে তিনি পরে বহিষ্কার করে দেন, কারণ সে ছিল অলস। ১৭৭৮ সালের এপ্রিল মাসে সংঘের নাম হলো ইলুমিনাতি। যার অর্থ “যারা কোনো বিষয়ে বিশেষ ভাবে আলোকিত বা জ্ঞানার্জনের দাবী করে”। সে সময় সংঘের সদস্য ছিল ১২। গ্রীষ্ম যেতে না যেতেই সদস্য সংখ্যা দাঁড়াল ২৭-এ! কারা হত সদস্য? জেনে অবাক হবেন, সচ্চরিত্র খ্রিস্টান ছিল তাদের কাম্য এবং সকল প্রকার ইহুদী আর মূর্তিপূজক ছিল নিষিদ্ধ এই সংঘে। এমনকি নারী, ধর্মগুরু এবং অন্য সিক্রেট সোসাইটির সদস্যরাও নিষিদ্ধ ছিল। স্বাগত জানানো হত ধনী, শিক্ষানবিশ আর ১৮-৩০ বছরের তরুণদের। ধীরে ধীরে ইউরোপ জুড়েও ছড়িয়ে পড়তে লাগল ইলুমিনাতির শাখা। তবে একদম সেকুলার হবার কারণে ইলুমিনাতির অভ্যন্তরে ধর্মবিদ্বেষ চোখে পড়তে লাগল। ১৭৮২ সালের দিকে ইলুমিনাতি-তে তিনটি শ্রেণীর সূচনা করা হয়। ক্লাস-১ হলো যারা সদ্য যোগ দিয়েছে। ক্লাস-২ হলো একটু উচ্চ পর্যায়ের যারা। আর ক্লাস-৩ হলো সবচেয়ে গোপনীয় জ্ঞানের অধিকারী যারা। ১৭৮৪ সালের শেষে, মোট সদস্য হয়ে যায় ৬৫০! যদিও অ্যাডাম দাবি করেন সংখ্যাটা আড়াই হাজার। তবে অ্যাডাম চেয়েছিলেন ইলুমিনাতি সিক্রেট সোসাইটির কথা খুবই গোপন রাখতে যেন ঘুণাক্ষরেও রসিক্রুসিয়ানরা না জানে। রসিক্রুসিয়ান হলো আরেক গুপ্তসঙ্ঘ এবং ইলুমিনাতির পুরোই বিপরীত। কারণ ইলুমিনাতি বিশ্বাস করত সেকুলারিজমে, আর রসিক্রুসিয়ানদের বিশ্বাস আর কর্ম ছিল জাদুবিদ্যা নিয়ে, অন্তত তৎকালীন ইলুমিনাতি সেটাই বিশ্বাস করত। রসিক্রুসিয়ান প্রতীক ইলুমিনাতি থেকে তাহলে কিভাবে সদস্য রিক্রুট করা চলত? সেটা হত একদম নীরবে আর গোপনে। ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগের মাধ্যমে। কিন্তু তারপরেও রসিক্রুসিয়ানরা জেনে গেলো। তা-ও এমন একজনের কল্যাণে যে কিনা ছিল দুই সঙ্ঘেরই সদস্য। ফলাফল দাঁড়াল- ইলুমিনাতি যে একটি নাস্তিক সংঘ, সেটা রটে গেল ইউরোপে। ধর্মহীন ইলুমিনাতির বিরুদ্ধে জোর গণমত গড়ে উঠল। ব্যাভারিয়ার শাসক চার্লস থিওডোর পুরোই ভয় পেয়ে গেলেন। তার সরকার সকল গুপ্ত সংঘ নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। এই ব্যান আসলো ১৭৮৫ সালের ২ মার্চ। অ্যাডাম পালিয়ে গেলেন আর ইলুমিনাতির প্রচুর নথিপত্র সরকারের হাতে এসে গেল, এবং দু’বছর বাদে সরকার সেটা প্রকাশও করে দিল। এরপর যে ইলুমিনাতির কী হলো ইতিহাস আমাদের তা নিশ্চিত করে বলে না। ১৭৯৮ সালের কিছু আগে জন রবিসন নামে Proofs of a Conspiracy এক বই লিখেন যেখানে দাবি করা হয় ইলুমিনাতি এখনও জোরসে বেঁচে আছে, বহাল তবিয়তে। অসম্ভব জনপ্রিয় হয় সে বই এবং আরেকটা বই যেখানে একই দাবি করা হয়। দুটো বই প্রচুর বিক্রি হয়। বইতে বলা হয় অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগের সেই ফ্রেঞ্চ বিপ্লবের পেছনের কলকাঠি নাকি আসলে ইলুমিনাতিই নেড়েছে। এ বই দুটো সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় নতুন আমেরিকাতেও। সেখানে রেভারেন্ড মোর্স ও অন্যান্যরা প্রচার করলেন ইলুমিনাতির বিরুদ্ধে। কিন্তু এই হুজুগ কমে গেল ১৮০০ সালের পর পর। মাঝে মাঝে অবশ্য মেসন-বিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠত বটে। বর্তমান কালে অবশ্য নানা সংঘই ইলুমিনাতি নাম দিয়ে নিজেদের দাবি করে যে তারাই সত্যিকারের ব্যাভারিয়ান ইলুমিনাতি। তবে তারা কেন যেন আবার গোপনীয়তার ধার ধারে না, যেটা আসলে প্রমাণ করে তারা আসল ইলুমিনাতি নয়। এমনকি তারা নিজেদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট আছে বলেও প্রচার করেঃ কথিত ইলুমিনাতি ওয়েবসাইট এমনকি সুন্দর গ্রাফিক্সসহ বিজ্ঞাপনও আছে তাদেরঃ বর্তমান এক ডলার নোটে আমেরিকার গ্রেট সিল দেখা যায়, সেখানে পিরামিডের উপর এক চোখ দেখা যায় যার নাম “Eye of Providence” বা “all-seeing eye of God”- আরো লিখা আছে লাতিনে E pluribus unum (অর্থ ‘Out of many, one’) ও Novus ordo seclorum (যার মানে New order of the ages)। ইলুমিনাতি তত্ত্ববিশ্বাসীগণ মনে করেন, এই এক চোখ প্রমাণ করে আমেরিকা ইলুমিনাতির দখলে আছে। পিরামিডের নিচে লেখা আছে MDCCLXXVI যা মূলত রোমান সংখ্যায় ১৭৭৬। অবাক কাণ্ড, ইলুমিনাতিও ১৭৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত! [অবশ্য, ১৭৭৬ ওখানে লিখা কারণ, ১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীনতা অর্জন করে।] সেই যে বই দুটো দাবি করেছিল ইলুমিনাতি বেঁচে আছে, শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সে মতবাদ রয়ে যায়। এক নজরে দেখে নেয়া যাক কী কী ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচলিত আছে ইলুমিনাতির নামে- “ ১) প্রচুর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মতে, শক্তিমান সিক্রেট সোসাইটি ইলুমিনাতি মূলত এ বিশ্বের সকল প্রধান ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে। ২) ফ্রেঞ্চ বিপ্লবের সূচনাও ইলুমাতির হাতেই। ৩) নেপোলিয়নের ওয়াটারলু যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করে ইলুমিনাতি। ৪) আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কেনেডির গুপ্তহত্যা আসলে ইলুমিনাতিই করিয়েছে, কারণ তিনি বাধা দিচ্ছিলেন তাদের কাজে। ৫) “নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার” ত্বরান্বিত করা। এই অর্ডারের মাধ্যমে সারা বিশ্ব থাকবে ইলুমিনাতির হাতের মুঠোয়। ১৯৯১ সালে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের কথা প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়র তার ভাষণে উল্লেখ করবার পর এই তত্ত্ব তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ৬) হলিউডের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ইলুমিনাতির দখলে। এর মাধ্যমে ইলুমিনাতি আপনার অবচেতন মনে তাদের বিশ্বাসগুলো ঢুকিয়ে দিচ্ছে, কিংবা আপনাকে ব্রেইনওয়াশ করছে। ৭) শয়তানের উপাসনার মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করে ইলুমিনাতি। খ্রিস্টান ও মুসলিম ষড়যন্ত্র তত্ত্বমতে, ইলুমিনাতির এক চোখা প্রতীক প্রমাণ করে যে, ইলুমিনাতি হলো সেই সংঘ যারা একচোখা দাজ্জাল (কিংবা বাইবেল মতে ৬৬৬ বা অ্যান্টিক্রাইস্ট) এর আগমনের পথ সুগম করছে। ৮) বলা হয়, এই ব্যক্তিরাও ইলুমিনাতির সদস্যঃ বারাক ওবামা, পোপ, রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, জর্জ ডব্লিউ বুশ, কানিয়ে ওয়েস্ট, বব ডিলান, রিহান্না, বিয়ন্সে, লেডি গাগা, জিম ক্যারি, ম্যাডোনা প্রমুখ। ৯) বব মার্লে, কেনেডি, মাইকেল জ্যাকসন, হিথ লেজার- এদেরকে স্যাক্রিফাইস হিসেবে উৎসর্গ করে ইলুমিনাতি। ১০) সারা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণকারী Bilderberg Group এর সাথে ইলুমিনাতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। [এ গ্রুপ নিয়ে আবার রয়েছে বিশাল থিয়োরি] ১১) ডিজনি কার্টুনের মাধ্যমে ইলুমিনাতি শিশুমনে ইলুমিনাতির বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে চায়। ১২) ইলুমিনাতির বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে একটি ইউএফও ক্র্যাশ করানো হয় আমেরিকার রজওয়েলে, সেখান থেকে চারজন এলিয়েনকে উদ্ধার করা হয়। আমেরিকান মিলিটারির সহায়তায় তারা ব্ল্যাকমেইল করে তাদেরকে বাধ্য করে এলিয়েন প্রযুক্তি বিনিময় করতে। তাছাড়াও কিছু আকার পরিবর্তনে সক্ষম রেপ্টিলিয়ান এলিয়েন দ্বারা তারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বদল করেছে, যেন তাদের মতই দেখতে এলিয়েনরা কাজ চালিয়ে যায়, যেমন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ একজন রেপ্টিলিয়ান এলিয়েন। তাছাড়া উন্নত ক্লোনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে আসল ব্যক্তিদের হুবহু ক্লোন বসিয়ে দিয়ে পুরো বিশ্বের দখল নিয়ে নিচ্ছে ইলুমিনাতি। কোন তত্ত্ব মিস করে গেলে আমাদের জানাতে পারেন। ড্যান ব্রাউনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডিমন্স’ মূলত ইলুমিনাতি নিয়ে নতুন করে গণমনে আগ্রহ জাগিয়ে তোলে, যদিও সে বই শেষ পর্যন্ত পাঠককে ইলুমিনাতি বিষয়ে হতাশ করে বসে। বইয়ের উপর করা চলচ্চিত্রে রবার্ট ল্যাংডন চরিত্রে অভিনয় করেন জনপ্রিয় অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস। Angels & Demons ছবির পোস্টার শত শত বছর ধরে অসংখ্য জল্পনা কল্পনার ইলুমিনাতি কি আসলেই কাজ চালাচ্ছে আড়ালে আবডালে, নাকি এটা কেবল উর্বর মস্তিষ্কের অবিরত কল্পনা?