একদিন ভূতের প্রসঙ্গ নিয়ে গল্প চলছিল। কেউ ভূত বিশ্বাস করে আবার কেউ করে না। মাঝখানে নীলা বলল, ভূত বা অশরীরী আত্মা আছে একথা আমি কোনোদিন বিশ্বাস করতাম না। এ নিয়ে বাড়ির ছোটদের উপর প্রায়ই রাগ করে বলতাম, ভূত বলে কিছু আছে নাকি? তোরা ভূত-ভূত করিস কেন? ভূতের কথায় কেন ভয় পাস?
ছোটদের বলছি বটে, তবে অনেকের মুখে একথাও শুনেছি যে, নির্জন সন্ধ্যায় বা গভীর রাতে ভূতেরা কোনো মানুষকে একা পেলেই ভয় দেখায়। ওরা নানান রকম রূপ ধরে সামনে আসে। তখন খুব সাহসী লোকও তার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। চমকে উঠে তার মন। লোকে বলে একা না বোকা। তাই অশুভ কিছু ঘটার আগেই সে দৌড়ে পালায়।
একদিন ছোটদের ভূতের বই পড়তে দেখে খুব চেঁচামেচি করছিলাম। হঠাৎ দাদুর কণ্ঠস্বর কানে এল। নীলা, একবার এদিকে আসতো। দাদুর কথা শুনে আমি তো ভয়ে মরি। কখন যে কি বেফাঁস কথা বলে ফেলেছি- সেকথা ভাবার আর সময় পেলাম না। পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম দাদুর সামনে। দাদু বললেন- হইচই করছিলি কেন?
ভূত!
তুই কি ভূত দেখেছিস?
ভূত দেখব আমি?
তুমি যে কি বলো দাদু ভূত বলে কিছু আছে নাকি যে ভূত দেখব?
ভূতে তোর বিশ্বাস নেই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি।
তুমি বিশ্বাস করো?
হ্যাঁ। কারণ, ভূতের পাল্লায় আমি পড়ে ছিলাম। ওরা অশরীরী আত্মা
বলে বাতাসে মিশে থাকে আর সর্বত্র বিরাজমান। ওদের সম্পর্কে আজে
বাজে কথা বলা ঠিক নয়। খারাপ আত্মাদে র প্রতিশোধ নিতে একটুও
সময় লাগে না।
দাদরু কথা শুনে আমি ভয় পেয়েগেলাম। ভাবলাম, দাদ-ুতো কখনো বাজে কথা বলেন না। তিনি যখন নিজর চোখে দেখেছেন তখন...। আমি বললাম, দাদু তুমি কি সত্যি ভূত দেখেছ?
দাদু বললেন, দেখেছি বলেই তো বলছি। কিন্তু একথা আমি এতদিন কাউকে বলিনি। আমি বললাম, দাদু গল্পটা একটু বলোনা, শুনলে ভূত সম্পর্কে অনেক আইডিয়া হবে।
বলব, তবে এখন নয়। সন্ধ্যার পর চা খেতেখেতে বাড়ির সবার সামনে বলব।
তো সন্ধ্যার পর বাড়ির সবাই দাদরু ঘরে গিয়ে বসলাম। মা নিজের হাতে চা তৈরি করে নিয়ে এল। সবার মনের মধ্যে তখন সে কি ছটফটানি! দাদরু দেখা ভূত-যেন এক বিশাল সত্যের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। দাদু চায়ে চুমকু দিচ্ছেন, আমাদের সবগুলো চোখ দাদুর মুখের নড়াচড়া দেখছি, আর অপেক্ষা করছি।
দাদু বললেন, ঘটনাটা যখন ঘটেছিল তখন তোমাদের অনেকেরই জন্ম হয়নি। চারদিকে বন-জঙ্গল ফাকা-ফাকা সব ঘরবাড়ি। তখন নানান রকম জীব-জানোয়ারও ছিল, যা এখন আর দেখা যায়না। সন্ধ্যা নামলে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যেত। বাড়িতে বাড়িতে টিম টিম করে জ্বলত প্রদীপের আলো। এবার ভেবেদেখো সেইদিন আর আজকের দিনের মধ্যে কত তফাৎ।
একদিন ফরিদপুর শহর থেকে ফিরছিলাম । মামলার ঝামেলা সারতে সারতে বেশ রাত হয়ে গেল।
মুড়ির টিনের মতো একটা বাস ছিল, সেটাও দেখি নেই। ঘোড়ার
গাড়িও পাওয়া গেলনা। শেষে পায়ে হেঁটেই রওনা করলাম। তখন
আমার শরীরে প্রচণ্ড শক্তি আর সাহসও ছিল । ভূত প্রেতের ভয় ছিলনা আমার।
তখন গভীর রাত। আকাশে ভাঙা চাদ, আমি হাঁটছি। আর দ'এক মাইল হাঁটলেই বাড়ি পৌঁছতে পারি । রাস্তার দু'পাশে ঝাড়-জঙ্গল, লম্বা লম্বা গাছপাল। হঠাৎ বাঁদিকের একটা বাগান থেকে মড়াত শব্দে গাছের একটা ডাল ভেঙে রাস্তার উপর পড়ল। আমার থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে ঘটনাটা ঘটল। দেখে ই থমকে দাঁড়ালাম। প্রকৃতি শান্ত, অথচ বেশ বড় একটা ডাল ভেঙে পড়ল রাস্তার উপর। আমি বুঝে নিলাম এটা অদৃশ্য কোনো আত্মার কারসাজি।
শুনেছি রাতে ভূতেরা কাউকে একা পেলে বাঁশ ঝাড়ের তাজা বাশ আড়াআড়ি করে পথের উপর হেলিয়ে রাখে। মানষু যদি বাঁশের উপর দিয়ে যেতে চায়, তাহলে চোখের পলকে মানষুটাসহ সেই বাঁশ উঠে যায় উপরে। আবার নিচে দিয়ে যেতে চাইলেও ভূত নাকি বাঁশটা চেপে ধরে মানুষের শরীরের উপর।
এসব কথা মনে হতেই জিকে গাছের একটা ডাল ভেঙে এগিয়ে চললাম। পড়ে থাকা ডালটার কাছে গিয়ে হাতের ডালটা দিয়ে কষে দিলাম একটা বাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে হুড়পাড় শব্দে ডালটা বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। শরীরের মধ্যে একটা ঝাকি দিয়ে উঠল আমার।
ভাবলাম, এই কাজটা কি আমি ভুল করলাম? আবার নতুন করে কোনো বিপদে পড়বো নাকি!
তারপর লাঠিটা হাতে নিয়ে হাটছি , মনের মধ্যে অন্যরকম সাহস।
হঠাৎ কানে এল বি ড়ালের মাও-মাও শব্দ। ডানে বায়ে তাকিয়ে কিছু না দেখতে পেয়ে শেষে পায়ের দিকে তাকতেই দেখি বকের পাখার মতো সাদা ছোট একটি বিড়ালছানা। ভাবলাম, এই বাচ্চাটা আমাকে কী করবে? হঠাৎ কেমন মায়া হল। বললাম, কেন আমার পেছনে লেগেছিস? তুই তো সত্যি কারের বিড়াল নস। বিড়াল হলে বাড়িতে নিয়ে যেতাম। বাচ্চাটা ডাকতে ডাকতে ঢুকে গেল ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে।
নতুন এক অভিজ্ঞতায় মনটা বেশ পুলকিত। সামনে ডান দিকে ছোট ফাঁকা মাঠ। বাঁদিকে দু'ঘর কামারের বাস। তারপর কলমি লতায় ছাওয়া একটা পুকুর। পুকুরপাড়ে দু'চারটা তালগাছ। ভাঙা চাঁদটা তখন খোড়াতে খোড়াতে পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে। মিনমিনে হাওয়া বইছে , প্রকৃতি যেন গভীর ঘুমে আছন্ন। পুকুরটা ছেড়ে ডানদিকে মোড় নিতেই দেখি দুটো বড় বড় শিয়াল রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাতের ডালটা উঁচু করে ধমক দিলাম, যা হাতে লাঠি দেখেছিস...।
শিয়াল দুটো আমার কথা যেন কানেই তুললো না। আমার দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। এবার আমি একটু বিপদের গন্ধ পেলাম। প্রায় দশহাত দূরে আমিও থকমে দাঁড়ালাম। মনের অজান্তেই বিসমিল্লাহ বলে দোআ কালাম পড়তে শুরু করেছি। অনেকক্ষণ পর ওরা একসাথে ডেকে উঠল দু'বার। তারপর মাটির কাছে মুখ নিয়ে কোনো কিছুর গন্ধ শুকতে শুকতে রাস্তা থেকে নেমে গেল বিলের দিকে।
মনের ভয়টা কেটে গেল। আমিও প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি।
কিন্তু প্রেতাত্মাটা তখনও আমার পিছু ছাড়েনি। কেমন যেন দিকভুলের মতো লাগতে লাগল। হঠাৎ আমার শরীরে এক ঝলক গরম বাতাস এসে লাগল। তার পরই সাদা শাড়ী পরা বেশ লম্বা একটি মেয়ে আমার পাশ কেটে দ্রুত সামনে চলে গেল। আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি কাঁপা-কাঁপা স্বরে বললাম, কে? কোনো উত্তর নেই। নীরব প্রকৃতির বুক চিড়ে ঠিক তখনই কুহক পাখির ডাক মিলিয়ে গেল দিগন্তে। তিনদিকে তিনটি পায়ে চলা পথ। মেয়েটি আমার সামনে দিয়ে হাঁটছে। আমি ভাবছি কোন পথে যবো? তারপর তাকে বললাম, তুমি
মানষুদের কেন ভয় দেখাও? কোনো কথা নেই সে হাঁটছে। আমিও লাঠি হাতে তার পেছন পেছন হাঁটছি। তখন আমার ভুল ভাবটা কেটে গেছে। সে হাটছে আমার বাড়ির দিকেই। আমি আবার বললাম, তুমি কি কিছু চাও? কোনো উত্তর নেই। আবার একটা দমকা বাতাসে নেড়ে চড়ে উঠল পাতা পল্লব। সে ই সাথে উধাও হয়ে গেল মেয়েটা। শরীরটা শির শির করে উঠল আমার। আর কানে বাজল, রাতে একা একা তোকে যেন আর না দেখি। আমি তিন লাফে বাড়ি এসে ঢুকলাম।
এই ঘটনাটা আমি কাউকে বললাম না। পরদিন সবাইকে ডেকে বললাম, রাত বারটার পর তোমরা কেউই একা একা বাড়ির বাইরে যাবে না। এটা আমার হুকুম। আসল কারণটা আর কাউকে জানালাম না। কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হলাম যে, এই কারণে অদৃশ্য জগতের আত্মাদের নিয়ে আজে বাজে কথা বলা ঠিক নয়। বাড়ির সবাই চুপচাপ দাদুর জীবনের গল্প শুনার পর কেউ যেন নড়াচড়া করতেও ভুলে গেলাম।
চোখের সামনে ভাসতে লাগল রাতের সেই ভূতুড়ে দৃশ্যগুলো। মনে হতে লাগলো সাদা শাড়ী পরা সেই পেতনিটা যেন আমাদের আম বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে সব দেখছে, শুনছে। আমাদের অবস্থা দেখে দাদু বললেন, তোমাদের ভয় পাওয়ার কি ছুনেই নেই। ওদের মধ্যে ভালো মন্দ দুই আছে। তাই তোমাদেরও বলছি, গভীর রাতে একা একা কেউ বাড়ির বাইরে থেকোনা। এখন সময়টা আরো খারাপ হয়ে গেছে।
এবার যার যার কাজে যাও তোমরা।
ছোটদের বলছি বটে, তবে অনেকের মুখে একথাও শুনেছি যে, নির্জন সন্ধ্যায় বা গভীর রাতে ভূতেরা কোনো মানুষকে একা পেলেই ভয় দেখায়। ওরা নানান রকম রূপ ধরে সামনে আসে। তখন খুব সাহসী লোকও তার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। চমকে উঠে তার মন। লোকে বলে একা না বোকা। তাই অশুভ কিছু ঘটার আগেই সে দৌড়ে পালায়।
একদিন ছোটদের ভূতের বই পড়তে দেখে খুব চেঁচামেচি করছিলাম। হঠাৎ দাদুর কণ্ঠস্বর কানে এল। নীলা, একবার এদিকে আসতো। দাদুর কথা শুনে আমি তো ভয়ে মরি। কখন যে কি বেফাঁস কথা বলে ফেলেছি- সেকথা ভাবার আর সময় পেলাম না। পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম দাদুর সামনে। দাদু বললেন- হইচই করছিলি কেন?
ভূত!
তুই কি ভূত দেখেছিস?
ভূত দেখব আমি?
তুমি যে কি বলো দাদু ভূত বলে কিছু আছে নাকি যে ভূত দেখব?
ভূতে তোর বিশ্বাস নেই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি।
তুমি বিশ্বাস করো?
হ্যাঁ। কারণ, ভূতের পাল্লায় আমি পড়ে ছিলাম। ওরা অশরীরী আত্মা
বলে বাতাসে মিশে থাকে আর সর্বত্র বিরাজমান। ওদের সম্পর্কে আজে
বাজে কথা বলা ঠিক নয়। খারাপ আত্মাদে র প্রতিশোধ নিতে একটুও
সময় লাগে না।
দাদরু কথা শুনে আমি ভয় পেয়েগেলাম। ভাবলাম, দাদ-ুতো কখনো বাজে কথা বলেন না। তিনি যখন নিজর চোখে দেখেছেন তখন...। আমি বললাম, দাদু তুমি কি সত্যি ভূত দেখেছ?
দাদু বললেন, দেখেছি বলেই তো বলছি। কিন্তু একথা আমি এতদিন কাউকে বলিনি। আমি বললাম, দাদু গল্পটা একটু বলোনা, শুনলে ভূত সম্পর্কে অনেক আইডিয়া হবে।
বলব, তবে এখন নয়। সন্ধ্যার পর চা খেতেখেতে বাড়ির সবার সামনে বলব।
তো সন্ধ্যার পর বাড়ির সবাই দাদরু ঘরে গিয়ে বসলাম। মা নিজের হাতে চা তৈরি করে নিয়ে এল। সবার মনের মধ্যে তখন সে কি ছটফটানি! দাদরু দেখা ভূত-যেন এক বিশাল সত্যের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। দাদু চায়ে চুমকু দিচ্ছেন, আমাদের সবগুলো চোখ দাদুর মুখের নড়াচড়া দেখছি, আর অপেক্ষা করছি।
দাদু বললেন, ঘটনাটা যখন ঘটেছিল তখন তোমাদের অনেকেরই জন্ম হয়নি। চারদিকে বন-জঙ্গল ফাকা-ফাকা সব ঘরবাড়ি। তখন নানান রকম জীব-জানোয়ারও ছিল, যা এখন আর দেখা যায়না। সন্ধ্যা নামলে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যেত। বাড়িতে বাড়িতে টিম টিম করে জ্বলত প্রদীপের আলো। এবার ভেবেদেখো সেইদিন আর আজকের দিনের মধ্যে কত তফাৎ।
একদিন ফরিদপুর শহর থেকে ফিরছিলাম । মামলার ঝামেলা সারতে সারতে বেশ রাত হয়ে গেল।
মুড়ির টিনের মতো একটা বাস ছিল, সেটাও দেখি নেই। ঘোড়ার
গাড়িও পাওয়া গেলনা। শেষে পায়ে হেঁটেই রওনা করলাম। তখন
আমার শরীরে প্রচণ্ড শক্তি আর সাহসও ছিল । ভূত প্রেতের ভয় ছিলনা আমার।
তখন গভীর রাত। আকাশে ভাঙা চাদ, আমি হাঁটছি। আর দ'এক মাইল হাঁটলেই বাড়ি পৌঁছতে পারি । রাস্তার দু'পাশে ঝাড়-জঙ্গল, লম্বা লম্বা গাছপাল। হঠাৎ বাঁদিকের একটা বাগান থেকে মড়াত শব্দে গাছের একটা ডাল ভেঙে রাস্তার উপর পড়ল। আমার থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে ঘটনাটা ঘটল। দেখে ই থমকে দাঁড়ালাম। প্রকৃতি শান্ত, অথচ বেশ বড় একটা ডাল ভেঙে পড়ল রাস্তার উপর। আমি বুঝে নিলাম এটা অদৃশ্য কোনো আত্মার কারসাজি।
শুনেছি রাতে ভূতেরা কাউকে একা পেলে বাঁশ ঝাড়ের তাজা বাশ আড়াআড়ি করে পথের উপর হেলিয়ে রাখে। মানষু যদি বাঁশের উপর দিয়ে যেতে চায়, তাহলে চোখের পলকে মানষুটাসহ সেই বাঁশ উঠে যায় উপরে। আবার নিচে দিয়ে যেতে চাইলেও ভূত নাকি বাঁশটা চেপে ধরে মানুষের শরীরের উপর।
এসব কথা মনে হতেই জিকে গাছের একটা ডাল ভেঙে এগিয়ে চললাম। পড়ে থাকা ডালটার কাছে গিয়ে হাতের ডালটা দিয়ে কষে দিলাম একটা বাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে হুড়পাড় শব্দে ডালটা বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। শরীরের মধ্যে একটা ঝাকি দিয়ে উঠল আমার।
ভাবলাম, এই কাজটা কি আমি ভুল করলাম? আবার নতুন করে কোনো বিপদে পড়বো নাকি!
তারপর লাঠিটা হাতে নিয়ে হাটছি , মনের মধ্যে অন্যরকম সাহস।
হঠাৎ কানে এল বি ড়ালের মাও-মাও শব্দ। ডানে বায়ে তাকিয়ে কিছু না দেখতে পেয়ে শেষে পায়ের দিকে তাকতেই দেখি বকের পাখার মতো সাদা ছোট একটি বিড়ালছানা। ভাবলাম, এই বাচ্চাটা আমাকে কী করবে? হঠাৎ কেমন মায়া হল। বললাম, কেন আমার পেছনে লেগেছিস? তুই তো সত্যি কারের বিড়াল নস। বিড়াল হলে বাড়িতে নিয়ে যেতাম। বাচ্চাটা ডাকতে ডাকতে ঢুকে গেল ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে।
নতুন এক অভিজ্ঞতায় মনটা বেশ পুলকিত। সামনে ডান দিকে ছোট ফাঁকা মাঠ। বাঁদিকে দু'ঘর কামারের বাস। তারপর কলমি লতায় ছাওয়া একটা পুকুর। পুকুরপাড়ে দু'চারটা তালগাছ। ভাঙা চাঁদটা তখন খোড়াতে খোড়াতে পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে। মিনমিনে হাওয়া বইছে , প্রকৃতি যেন গভীর ঘুমে আছন্ন। পুকুরটা ছেড়ে ডানদিকে মোড় নিতেই দেখি দুটো বড় বড় শিয়াল রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাতের ডালটা উঁচু করে ধমক দিলাম, যা হাতে লাঠি দেখেছিস...।
শিয়াল দুটো আমার কথা যেন কানেই তুললো না। আমার দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। এবার আমি একটু বিপদের গন্ধ পেলাম। প্রায় দশহাত দূরে আমিও থকমে দাঁড়ালাম। মনের অজান্তেই বিসমিল্লাহ বলে দোআ কালাম পড়তে শুরু করেছি। অনেকক্ষণ পর ওরা একসাথে ডেকে উঠল দু'বার। তারপর মাটির কাছে মুখ নিয়ে কোনো কিছুর গন্ধ শুকতে শুকতে রাস্তা থেকে নেমে গেল বিলের দিকে।
মনের ভয়টা কেটে গেল। আমিও প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি।
কিন্তু প্রেতাত্মাটা তখনও আমার পিছু ছাড়েনি। কেমন যেন দিকভুলের মতো লাগতে লাগল। হঠাৎ আমার শরীরে এক ঝলক গরম বাতাস এসে লাগল। তার পরই সাদা শাড়ী পরা বেশ লম্বা একটি মেয়ে আমার পাশ কেটে দ্রুত সামনে চলে গেল। আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি কাঁপা-কাঁপা স্বরে বললাম, কে? কোনো উত্তর নেই। নীরব প্রকৃতির বুক চিড়ে ঠিক তখনই কুহক পাখির ডাক মিলিয়ে গেল দিগন্তে। তিনদিকে তিনটি পায়ে চলা পথ। মেয়েটি আমার সামনে দিয়ে হাঁটছে। আমি ভাবছি কোন পথে যবো? তারপর তাকে বললাম, তুমি
মানষুদের কেন ভয় দেখাও? কোনো কথা নেই সে হাঁটছে। আমিও লাঠি হাতে তার পেছন পেছন হাঁটছি। তখন আমার ভুল ভাবটা কেটে গেছে। সে হাটছে আমার বাড়ির দিকেই। আমি আবার বললাম, তুমি কি কিছু চাও? কোনো উত্তর নেই। আবার একটা দমকা বাতাসে নেড়ে চড়ে উঠল পাতা পল্লব। সে ই সাথে উধাও হয়ে গেল মেয়েটা। শরীরটা শির শির করে উঠল আমার। আর কানে বাজল, রাতে একা একা তোকে যেন আর না দেখি। আমি তিন লাফে বাড়ি এসে ঢুকলাম।
এই ঘটনাটা আমি কাউকে বললাম না। পরদিন সবাইকে ডেকে বললাম, রাত বারটার পর তোমরা কেউই একা একা বাড়ির বাইরে যাবে না। এটা আমার হুকুম। আসল কারণটা আর কাউকে জানালাম না। কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হলাম যে, এই কারণে অদৃশ্য জগতের আত্মাদের নিয়ে আজে বাজে কথা বলা ঠিক নয়। বাড়ির সবাই চুপচাপ দাদুর জীবনের গল্প শুনার পর কেউ যেন নড়াচড়া করতেও ভুলে গেলাম।
চোখের সামনে ভাসতে লাগল রাতের সেই ভূতুড়ে দৃশ্যগুলো। মনে হতে লাগলো সাদা শাড়ী পরা সেই পেতনিটা যেন আমাদের আম বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে সব দেখছে, শুনছে। আমাদের অবস্থা দেখে দাদু বললেন, তোমাদের ভয় পাওয়ার কি ছুনেই নেই। ওদের মধ্যে ভালো মন্দ দুই আছে। তাই তোমাদেরও বলছি, গভীর রাতে একা একা কেউ বাড়ির বাইরে থেকোনা। এখন সময়টা আরো খারাপ হয়ে গেছে।
এবার যার যার কাজে যাও তোমরা।