Golpo/Adda

Go Back
রূপকথার গল্প

টানা সাত দিন ধরে লোকমান সাহেবের জ্বর। প্রথমে সবাই স্বাভাবিক জ্বর মনে করলেও চার দিনের মাথায় লোকমান সাহেবের কপালের এক অংশে ঘামাচির মতো গুটি দেখা দিল। সঙ্গে ব্যথা ও চুলকানি। পরিবারের সবাই প্রথমে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করালেও অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং জানান, তিনি হার্পিস জস্টার ভাইরাসে আক্রান্ত। এ রোগ থেকে তাকে সুস্থ হতে কিছু না হলেও ছয় মাস সময় লাগবেই। লোকমান সাহেব সোনাপুর ইউনিয়নের টানা তিনবারের চেয়ারম্যান। এলাকায় তার জনপ্রিয়তা অনেক। না হওয়ার কোনো কারণ নেই, গ্রামের সহজ–সরল মানুষকে অল্প একটু দিলেই তারা খুশি। সারা দিন রাজনীতি-জনসেবা করে বেড়ান। তার দুইটা ছেলে শহরে লেখাপড়া করে। তবে তার রাজনীতির নেশা আর হাইফাই চলাফেরা দেখলেই বোঝা যায়, রাজনীতির মাঠে তিনি কতটা সৎ! রাজনৈতিক কারণে সব সময় এদিক–ওদিক ছোটাছুটি করতে হয়। কিন্তু এ রোগ হয়ে তার হয়েছে মহাবিপদ। একটু সূর্যের আলো মুখে লাগলেই সেখানে চুলকানি আর ব্যথা। তাই ঠিকমতো বাইরে বের হতে পারেন না। কিন্তু তার স্থির থাকলে হবে না। সামনে ইলেকশন। জনগণের মন জয় করতে চাইলে তাদের সাথে এখন একটু চলাফেরা করতে হবে। এখন এমন এক ম্যাজিক পাওয়ার চাই, যেটা দিলে তার এই রোগ নিমেষে শেষ হয়ে যাবে। তাই সে হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক—এককথায় সব ধরনের ওষুধ ব্যবহার ও সেবন করতে শুরু করল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। এভাবে চার-পাঁচ মাস কেটে গেল। কিন্তু রোগ নিরাময়ের কোনো বালাই নেই। তারপর চেয়ারম্যান সাহেবের কাছের লোক মতি মিয়া এক কবিরাজের কথা বলে। মতি মিয়া চেয়ারম্যান সাহেবের খুব বিশ্বস্ত লোক। তার সকল দুই নম্বরি কাজ–কাম তিনি দেখাশোনা করেন। অন্যদিকে মতি মিয়া কোথাকার এক গোলাম পীরের মুরিদ। সেখান থেকেই নাকি আক্কাস কবিরাজের সাথে পরিচয়। অবশ্য মতি মিয়া অনেক আগে থেকেই এ কবিরাজের কথা বলছিল। কিন্তু লোকমান চেয়ারম্যান ডাক্তারের প্রতি বিশ্বাস রাখতে চেয়েছিল, তাই সে মতি মিয়ার কথায় কান দেয়নি। শেষমেশ না পেরে তিনি মতি মিয়াকে বললেন, ‘মতি মিয়া, তোমার সেই পরিচিত কবিরাজকে একবার আনলে হতো না।’ ‘আপনি যা বলবেন। আমি আজকে খবর পাঠাচ্ছি। আশা করি, তিনি কালকের মধ্যেই এখানে চলে আসবেন।’পরের দিন বিকেলে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আক্কাস কবিরাজের আগমন হলো। লোকটি মাঝ বয়সের হবে। মুখে একগাদা কাঁচা–পাকা দাড়ি। সেই বড় বড় জট পাকা চুল। চোখের দিকে তাকালেই মনে হয়, এ চোখে যেন অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। আক্কাস কবিরাজ কখনো এক জায়গায় থিতু হয়ে থাকেন না। কোনো এক জায়গায় বেশি হলে দু–এক মাস থাকেন। সন্ধ্যার দিকে তিনি চেয়ারম্যান সাহেবকে ভালো করে পরখ করে দেখলেন। বললেন, ‘সব শেষ ডাক্তার জিন্নাত মাহমুদের কাছে গিয়েছিলেন, তাই না?’ সত্যিই তো, শেষবার ডাক্তার জিন্নাত মাহমুদকে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু এ কবিরাজ জানলে কীভাবে! মতি কি তবে সত্যি বলেছিল, উনি নাকি অনেক বড় কবিরাজ। তিনি মানুষের মুখ দেখেই তার ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। নাকি মতি মিয়া নিজেই কবিরাজকে এসব কথা বলেছেন। কবিরাজ বললেন, আপনার এই রোগের চিকিৎসা কোনো ডাক্তারি শাস্ত্রে নেই। আমি আপনার মাথায় ফুঁ দিয়ে দিয়েছি, আর একটু পানি পড়া দিয়ে দিচ্ছি। আপনি প্রতিদিন নিয়ম করে, তিন বেলা দুই চামচ করে এটি পান করবেন। আমি সাত দিন পর আবার আপনাকে দেখে যাব। ইনশাল্লাহ, আপনি এ রোগ থেকে মুক্তি পাবেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, দুদিন পর থেকে লোকমান চেয়ারম্যানের চুলকানি কমতে থাকল। সাত দিনের মাথায় তার চুলকানি নেই বললেই চলে। তবে চেয়ারম্যান সাহেব পারিবারিক চাপে ডাক্তারি ওষুধ খাওয়া ছাড়েন নাই। ঠিক সাত দিনের মাথায় চেয়ারম্যানের বাড়িতে সেই কবিরাজের আবার দেখা মিলল। কবিরাজকে দেখে চেয়ারম্যান তো আনন্দে আত্মহারা। তিনি কবিরাজকে বেশ কিছু টাকা বকশিশ দিলেন। দুপুরের খাবার খেয়ে, কবিরাজ নতুন গন্তব্যে যাবার উদ্দেশে প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু চেয়ারম্যান তাকে ছাড়তে রাজি নন। বললেন, ‘আপনি আমাদের বাইরের ঘরটাতে থাকতে পারেন। গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করতে পারেন।’ কবিরাজ থাকতে রাজি হলো। দিন কয়েক যেতে না যেতেই আক্কাস কবিরাজ গ্রামের সবার কাছে পরিচিত নাম হয়ে উঠল। হবেই বা না কেন, তার একটা ফুঁ বা পানি পড়াতেই যেকোনো রোগ সেরে উঠছে। সব থেকে বড় কথা, তিনি চিকিৎসা বাবদ কোনো বকশিশ নিচ্ছেন না। এটা চেয়ারম্যানের আদেশ। কবিরাজের যত টাকা লাগে, উনি দেবেন। আর দুই মাস পরে ইউনিয়ন নির্বাচন। এই দুই মাস কবিরাজ এখানে থিতু হয়ে থাকলেই হবে। আর এদিকে এমনও দেখা যাচ্ছে, রোগী কোনো কারণে কবিরাজের সামনে উপস্থিত হতে পারছে না, তাতেও কোনো সমস্যা নেই, রোগের নাম ও রোগের বর্ণনা দিলেই তিনি এক ফুঁ দিয়ে দিচ্ছেন। এতে নাকি সেই রোগ সেরে যাচ্ছে। এদিকে বছর দুয়েক আগে বদরুল ব্যাপারীর ছেলে মানিক মিয়া গ্রামে একটি ফার্মেসি দিয়েছিলেন। মানিক শিক্ষিত ছেলে। ডিপ্লোমা-ইন-ফার্মেসিতে পড়েছে। চাইলে একটা ভালো চাকরি করতে পারত, কিন্তু গ্রামের মানুষের কথা ভেবে আর করেনি। বদরুল ব্যাপারী অবশ্য বলেছিলেন শহরের দিকে দোকানটা দিতে। এতে বেচাকেনা ভালো হবে। কিন্তু মানিক সাফ বলে দিয়েছিলেন, গ্রামের মানুষ অনেক কষ্ট করে শহরে ওষুধ কিনতে যায়। তাই সে গ্রামে দোকান দেবে। তবে এখন আক্কাস কবিরাজ আসার কারণে মানিক মিয়ার দোকান যেন গ্রীষ্মের দুপুরের মতো হাহাকার। এতে অবশ্য গ্রামের মানুষের মাথাব্যথা নেই।আমাদের বন্ধুমহল এ নিয়ে বেশ তর্কবিতর্ক হয়। আজও তেমন তর্কবিতর্ক চলার সময় মোবাইল বেজে উঠল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখি, ইতি ফোন দিয়েছে। ইতি আর আমি শহরে একসঙ্গে পড়ালেখা করি। ও আমার বেশ ভালো বান্ধবী। কলটা রিসিভ করে কেমন আছিস বলতেই ও বলে উঠল, না রে দোস্ত, আমার অবস্থা খুবই খারাপ। তিন দিন আগে মাছ খেতে গিয়ে গলায় কাঁটা ফুটে গিয়েছিল। সেকি ব্যথা! ডাক্তার দেখিয়েছি, ওষুধ খেয়েছি। কিন্তু কিছুতেই ব্যথা কমছে না। আর কিছু তো খেতেই পারছি না। বললাম, ‘আর দুই দিন দেখ, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ না দোস্ত, আমি আর পারছি না। খুব অসহ্য ব্যথা। তখন আমার আক্কাস কবিরাজের কথা মনে হলো। বললাম, ‘আমাদের গ্রামে এক কবিরাজ আছে, রোগীর নাম আর গলার কোন অংশে কাঁটা ফুটেছে বললেই ফুঁ দিয়েই সব ঠিক করে দেয়।’ পাশ থেকে রাকিব বলে উঠল, ‘আরে ব্যাটা, নামটাম কিছু বলা লাগবো না। এমনিতে ঠিক হয়ে যাইব।’ ইতি বলল, ‘আরে, এইগুলা হয় নাকি? তুই আমার সাথে মজা করিস না দোস্ত। আমি কিন্তু খুবই সিরিয়াস।’ ইতি শহরের মেয়ে। এই সব কবিরাজের প্রতি ওর একেবারে বিশ্বাস নেই। তারপরেও অনেক বিপদে পড়েছে বলে বলল, ‘আচ্ছা, কবিরাজকে বলে দেখ কাজ হয় নাকি।’ ‘ঠিক আছে, আজ রাতে কবিরাজকে তোর কথা বলব। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবি, তোর গলার কাঁটা কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেছে।’ পরদিন ভোরে দেখি, ইতি আবার কল দিয়েছে। আমি সাধারণত অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। কলটা একেবারে রিসিভ করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। ইতিও নাছোড়বান্দা দেখি। দুইবার কল কেটে দিয়ে তৃতীয়বারে কল ধরলাম। ‘হ্যালো, এত সকালে ঘুম ভাঙালি কেন? কী হয়েছে তাড়াতাড়ি বল?’ ‘দোস্ত, জানিস, আমার গলার কাঁটা একেবারেই ভ্যানিশ। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, গলার ব্যথা নেই। এখন ঠিকঠাক খেতেও পারছি। দোস্ত পারলে কিছু জাদুমন্ত্র শিখে নিস। এগুলো খুবই ভালো। এগুলা বিশ্বাস করতে হয় রে দোস্ত। আমাদের দাদা–নানার আমলের মানুষেরা তো এভাবে চিকিৎসা করেছে। আমি কলটা কেটে দিলাম। মানুষের বিশ্বাস বড়ই অদ্ভুত। ভাগ্যিস, বেচারির গলার কাঁটা নেমে গিয়েছিল। কাল রাতে যে কবিরাজকে ওর কথা বলব, সেই কথা তো আমার মনেই ছিল না!