এক দেশে ছিল এক রাজা। তার ছিল হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া আর গাধাশালে গাধা। গাধা রাজার অনেক প্রিয় প্রাণী, তাই তার গাধাশালে ছিল ১০০ সেরা গাধা। রাজার ছিল তিন রানি। বড় রানি, মেজ রানি আর ছোট রানি। বড় রানি সাতেও নেই পাঁচেও নেই। নিজের ঘরে শুয়েবসে কৌতুকের বই পড়ে আর দিনরাত খিকখিক করে হাসে। মেজ রানি কিন্তু সাতেও আছে পাঁচেও আছে, ষড়যন্ত্র করে বেড়ায়; সেনাপতিকে ডেকে নিয়ে মাঝেমধ্যে কী সব গুজগুজ করে। আর ছোট রানি তো সবার ছোট; সারা দিন টইটই করে শাহি দরবারে ঘোরে আর গুনগুন করে গান গায়। তবে তার গানের গলা ভালো। রাজা মাঝেমধ্যে ডেকে নিয়ে তার গান শোনেন।
এ ছাড়া রাজার বিয়ের রোগ আছে। মাঝেমধ্যেই হুট করে বিয়ে করে বসেন। যেমন কিছুদিন আগে দরবারের পেছনের শাহি কুয়ায় পানি তুলত যে মেয়েটি, তাকে দেখে রাজার পছন্দ হয়ে গেল। তাকে বিয়ে করে ফেললেন তিনি। সে এখন দরবারের ‘কুয়ারানি’। তার কিছুদিন পর দরবারের যে প্রধান বুয়া ছিল, তাকেও রাজার পছন্দ হয়ে গেল, তাকেও বিয়ে করে ফেললেন। সে এখন শাহি দরবারের ‘বুয়ারানি’।
রাজা সপ্তাহে এক দিন দরবারে বিচারে বসেন। তার বিচারও অদ্ভুত। যেমন দুজন প্রজা এল, বলল, ‘জাহাঁপনা, আমার জমির ওপর একটা তালগাছ আছে, আমি বলি, তালগাছটা আমার। ও মানে না, ও বলে ওটা নাকি তার জমির ওপর।’দ্বিতীয় লোকটা হাউমাউ করে ওঠে, ‘জাহাঁপনা, মিথ্যা কথা। তালগাছটা আমার দাদা নিজের হাতে লাগিয়েছিল আমাদের জমিতে। এখন সে বলছে তালগাছটা তার।’ সব শুনে রাজা বললেন, ‘থামো তোমরা।’ তারপর একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর হুকুম দিলেন, ‘ওই তালগাছ তোমাদের কারও নয়, এই কে আছ, বনমন্ত্রীকে ডাকো।’ বনমন্ত্রী এল।
‘বনমন্ত্রী?’
‘জি, জাহাঁপনা।’
‘ওদের জমির তালগাছটা তুলে এনে আমাদের দরবারের শাহি বাগানে লাগানোর ব্যবস্থা করো।’
রাজার হুকুম বলে কথা। পরদিনই তালগাছ বহু কায়দা করে তুলে এনে দরবারের শাহি বাগানে লাগানো হলো। পরদিনই তালগাছ মরে ভূত। এই হচ্ছে রাজার বিচার।
যাহোক, এভাবেই চলছিল। হঠাৎ রাজ্যে এক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটল! কী রোগ? ‘হাসিরোগ’। হয়তো কোনো প্রজা ঘুমুচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে হা হা করে হাসা শুরু করল। তারপর সারা দিন হেসে সন্ধ্যায় ঠাস করে মরে গেল। একি ভয়ানক রোগ! শত শত প্রজা হাসতে হাসতে মরতে লাগল। কি নারী, কি পুরুষ, কি বৃদ্ধ, কি বাচ্চা—সবাই হাসতে হাসতে মরতে লাগল। রাজা চিন্তায় পড়লেন। দরবারের প্রধান কবিরাজকে খবর দেওয়া হলো।কবিরাজ?’
‘জি, জাহাঁপনা?’
‘এ কী রোগ? এই রোগের চিকিত্সা কী?’
‘চিকিত্সা একটাই।’
‘কী?’
‘বড় রানিকে গ্রেপ্তার করে গারদে পুরতে হবে। উনি সারা দিন হাসেন আর সেই হাসির জীবাণু এখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।’
‘ঠিক তো।’
রাজার নির্দেশে তখনই বড় রানিকে গ্রেপ্তার করা হলো। বড় রানি বলল, ‘আমাকে গারদে পোরো আর যা–ই করো, আমার সঙ্গে কৌতুকের বইগুলো কিন্তু দিয়ো গো...হি হি হি।’
কিন্তু কী আশ্চর্য, তাতেও হাসিরোগ কমল না! রাজা ফের কবিরাজকে ডেকে পাঠালেন। কবিরাজ এল।
‘জাহাঁপনা, ডেকেছেন?’
‘হ্যাঁ। কই বড় রানিকে গ্রেপ্তার করলাম, এখনো তো হাসিরোগ থামল না।’
‘কী করে থামবে, জাহাঁপনা। বড় রানি তো গারদে বসেও হাসছেন। তার হাসি বন্ধ না হলে তো এই রোগ যাবে না।’
‘তাহলে উপায়?’
‘বড় রানির কাছ থেকে কৌতুকের বইগুলো সরিয়ে নিতে হবে। তাহলে যদি তার হাসি বন্ধ হয়। উনি হাসলেই রোগটা ছড়ায়।’
‘হুম, বুঝলাম।’
রাজা হুকুম দিলেন, ‘কে আছ? জলদি বড় রানির কাছ থেকে সব কৌতুকের বই সরিয়ে ফেলো।’ তা–ই করা হলো। এমনটা যে হবে, বড় রানি আগেই সন্দেহ করেছিলেন। এ জন্য তিনি ভালো কৌতুকগুলো একটা খাতায় লিখে বিছানার নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন। পেয়াদারা সব বই নিয়ে গেলে পরে তিনি খাতা বের করে খুনখুন করে হাসতেই লাগলেন, হাসতেই লাগলেন...।কিন্তু হাসির রোগ তো যায় না। প্রজারা এখনো হাসতে হাসতেই মরছে। ভয়ংকর খবর হচ্ছে তিনটা হাতি, সাতটা ঘোড়াও হাসতে হাসতে নাকি মারা গেছে। হাতি–ঘোড়াও যে হাসে, এটা আগে রাজার জানা ছিল না। তবে আশার কথা, গাধারা কেউ হাসছে না। তিনি প্রধান কবিরাজকে তলব করলেন। কবিরাজ আসে না। রাজা হুংকার দিলেন।
‘কী হলো, কবিরাজ কই? এখনো আসে না কেন?’
‘জাহাঁপনা, কবিরাজকে হাসিরোগে ধরেছে। উনি বাসায়, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সকাল থেকে হাসছেন। মনে হয় সন্ধ্যা নাগাদ হাসতে হাসতেই পটল তুলবেন।’
রাজা হতভম্ব হয়ে গেলেন। এখন উপায়?
আরে কী আশ্চর্য, পরদিন সকালে রাজা হাসতে হাসতে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন এবং হাসতেই থাকলেন, হাসতেই থাকলেন। তাকেও হাসিরোগে ধরেছে। রানিরা চিন্তিত হলো, দরবারের সবাই চিন্তিত হলো। এখন কী হবে? রাজা তখনো হাসছেন হি হি হা হা হো হো...। হাসতে হাসতে তিনি মন্ত্রীদের ডাকলেন।
‘শোনো, তোমরা...হা হা হি হি...।’
‘জি জাহাঁপনা, বলুন।’
‘হো হো, হাসিরোগের কারণ আমি ধরতে পেরেছি, হি হি হি।’
‘কী কারণ?’
‘হি হি, ওহ! পেট ব্যথা করছে হাসির চোটে…হো হো।’
‘জাহাঁপনা, কারণটা জলদি বলুন।’
‘কারণ হচ্ছে আমার রাজ্য শাসন, হা হা হি হি...’
‘মানে?’
‘মানে হি হি হা হা...মানে, আমার রাজ্য শাসন দেখে ওরা এত দিন মুখ বুজে ছিল, এখন হঠাৎ হাসতে শুরু করেছে, হো হো...’
‘এখন এর চিকিত্সা কী?’
‘হা হা হা, মনে আছে? অনেক আগে একজন জ্ঞানীকে রাজ্য থেকে বের করে দিয়েছিলাম? হা হা হা...’
‘জি জাহাঁপনা।’
‘হি হি, ওকে ফিরিয়ে আনো।’
‘তারপর? তার কাছ থেকে পরামর্শ নাও...হো হো হি হি...তিনি যা বলেন শোনো। হি হি...নতুন ভালো একজন রাজা খুঁজে বের করে দেবেন উনি, হো হো...হা হা ...আহ...’ সবার সামনে হাসতে হাসতেই রাজা মারা গেলেন। তখন গাধাশালের সব গাধা হাসতে শুরু করল হি হি করে। তারা কি আনন্দে হাসছে, না হাসিরোগের কারণে হাসছে, নাকি রাজার জন্য দুঃখে হাসছে, বোঝা গেল না। তবে কেউ কেউ বলে, গাধাগুলো নাকি দুঃখেও হাসে, এ জন্যই ওগুলো গাধা।
সূত্র এই গল্পটার লেখক আমি না