কমলবাবু বললেন, ‘আমি পাড়াতেই থাকি, হিন্দুস্থান পার্কের কিনারায়। আপনাকে অনেকবার দেখেছি, আলাপ করবার ইচ্ছে হয়েছে কিন্তু সাহস হয়নি। আজ একটা সূত্র পেয়েছি, তাই ভাবলাম এই ছুতোয় আলাপটা করে নিই। আমার জীবনে একটা ছোট্ট সমস্যা এসেছে–‘
‘সমস্যা!’ ব্যোমকেশ সিগারেটের কৌটো এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বলুন বলুন, অনেকদিন ও বস্তুর মুখদর্শন করিনি।’
গ্রীষ্মের একটি রবিবার সকালে ব্যোমকেশের কেয়াতলার বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল। কমলবাবুর চেহারাটি নাড়ুগোপালের মত, কিন্তু মুখের ভাব চটপটে বুদ্ধিসমৃদ্ধ। তিনি হাসিমুখে একটি সিগারেট নিয়ে ধরালেন, তারপর গল্প আরম্ভ করলেন, ‘আমার নাম কমলকৃষ্ণ দাস, কাছেই ভারত কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের শাখা আছে, আমি সেখানকার ক্যাশিয়ার। বছর দেড়েক আছে পুরুলিয়া থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছি।
‘কলকাতায় এসেই মুশকিলে পড়ে গেলাম; কোথাও বাসা খুঁজে পাই না। শেষ পর্যন্ত একটি লোক তার বাড়ির নীচের তলায় একটি ঘর ছেড়ে দিল। ফ্যামিলি আনা হল না, স্ত্রী আর মেয়েকে পুরুলিয়ায় রেখে একলা বাসায় উঠলাম।
‘বাড়িওয়ালার নাম অক্ষয় মণ্ডল। বাড়িটি দোতলা; নীচের তলায় দু’টি ঘর, ওপরে দু’টি; যাতায়াতের রাস্তা আলাদা। অক্ষয় মণ্ডল দোতলায় একলা থাকে, কিন্তু তার কাছে লোকজনের যাতায়াত আছে। মিষ্টভাষী লোক, কিন্তু কী কাজ করে বুঝতে পারলাম না। মাঝে মাঝে আমার ঘরে এসে গল্পসল্প করত, কিন্তু আমাকে কোনদিন দোতলায় ডাকত না পড়শীদের সঙ্গেও যাতায়াত ছিল না। আমাদের ব্যাঙ্কে ওর একটা চালু খাতা ছিল।
‘যাহোক, এইভাবে মাস তিনেক কাটার পর একদিন একটা ছুটির দিনে আমার অফিসের একজন সহকর্মী বন্ধুর বাড়িতে রাত্রে নেমন্তন্ন ছিল। ফিরতে রাত হয়ে গেল। বাসায় ফিরে দেখি অক্ষয় মণ্ডল দোতলা থেকে নেমে এসে সিঁড়ির দরজায় তালা লাগাচ্ছে, তার পায়ের দু’পাশে দু’টি সুটকেশ। বললাম, “একি, এত রাত্রে কোথায় চললেন?”
‘আমায় দেখে অক্ষয় মণ্ডল কেমন হকচকিয়ে গেল; তারপর সুটকেশ দুটো দু’হাতে নিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল, একটু গাঢ় গলায় বলল, “কমলবাবু, আমাকে হঠাৎ বাইরে যেতে হচ্ছে। কবে ফিরব কিছু ঠিক নেই।”
‘দেখলাম তার চোখ দুটো লাল হয়ে রয়েছে। বললাম, ‘সে কি, কোথায় যাচ্ছেন?”
‘তার মুখে হাসির মত একটা ভাব ফুটে উঠল। সে বলল, “অনেক দূর। আচ্ছা, চলি।”
‘আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে কয়েক পা গিয়ে থমকে দাঁড়াল, তারপর ফিরে এসে বলল, “কমলবাবু, আপনি সজ্জন, ব্যাঙ্কে চাকরি করে; আপনাকে একটা কথা বলে যাই। সাত দিনের মধ্যে আমি যদি ফিরে না আসি, আপনি আমার পুরো বাড়িটা দখল করবেন। আপনাদের ব্যাঙ্কে আমার অ্যাকাউণ্ট আছে, মাসে মাসে দেড়শো টাকা ভাড়া আমার খাতায় জমা দেবেন।–আচ্ছা।”
‘অক্ষয় মণ্ডল চলে গেল। আমি স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর বিস্ময়ের চটকা ভেঙে খেয়াল হল, অক্ষয় মণ্ডল তার দোরের চাবি আমাকে দিয়ে যায়নি।
‘সে যাহোক, আস্ত বাড়িটা পাওয়া যেতে পারে এই আশায় মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল। মনে হল অক্ষয় মণ্ডল অগস্ত্য যাত্রা করেছে, আর শীগ্গির ফিরবে না।
‘পরদিন সকালে স্ত্রীকে চিঠি লিখে দিলাম–সংসার গুটিয়ে তৈরী থাকো, বাসা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
‘আশায় আশায় দুটো দিন কেটে গেল। তিনি দিনের দিন গন্ধ বেরুতে আরম্ভ করল। বিকট গন্ধ, মড়া-পচা গন্ধ। গরমের দিনে মাছ মাংস পচে গিয়ে যে-রকম গন্ধ বেরোয় সেই রকম গন্ধ আসছে।
‘সন্দেহ হল, পুলিসে খবর দিলাম। পুলিস এসে তালা ভেঙে ওপরে উঠল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। গিয়ে দেখি বীভৎস কাণ্ড। ঘরের মেঝের ওপর একটা মড়া হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে, তার কপালে একটা ফুটো। সে-রাত্রে আমি যখন নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম, সেই সময় অক্ষয় মণ্ডল লোকটাকে গুলি করেছে, তারপর দামী জিনিসপত্র টাকাকড়ি সুটকেশে পুরে নিয়ে কেটে পড়েছে।
‘দেখতে দেখতে একপাল পুলিস এসে বাড়ি ঘিরে ফেলল। লাশ ময়না তদন্তের জন্যে পাঠানো হল। দারোগাবাবু আমাকে জেরা করলেন। তারপর খানাতল্লাশ আরম্ভ হল। নিরপেক্ষ সাক্ষী হিসাবে পাড়ার একটি ভদ্রলোক এবং আমি সঙ্গে রইলাম।
‘খানাতল্লাশে কিন্তু বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না। কেবল একটা দেরাজের মধ্যে কয়েকটা লোহার পাত দিয়ে তৈরী কৌটোর মত জিনিস পাওয়া গেল; সিগারেটের প্যাকেটে রুপোলি তবকের মধ্যে যেমন সিগারেট মোড়া থাকে, অনেকটা সেই রকম লম্বাটে ধরনের তবক, খুব পাতলা লোহা দিয়ে তৈরী, কিন্তু অভ্যন্তর ভাগ শূন্য। দারোগাবাবু সেগুলো নিয়ে চিন্তিতভাবে নাড়াচাড়া করলেন, কিন্তু হালকা লোহার মোড়ক কোন্ কাজে লাগে বোঝা গেল না।
‘যাহোক, সেদিনকার মত তদন্ত শেষ হল, পুলিস চলে গেল। আমার মনে কিন্তু অস্বস্তি লেগে রইল। তিন-চার দিন পরে থানায় গেলাম। সেখানে গিয়ে খবর পেলাম মৃত ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে; আঙুলের ছাপ ও অন্যান্য দৈহিক চিহ্ন থেকে প্রকাশ পেয়েছে যে মৃত ব্যক্তির নাম হরিহর সিং; দাগী আসামী ছিল, মাদকদ্রব্য এবং সোনা-রূপোর চোরাকারবার করত। অক্ষয় মণ্ডলের সঙ্গে কোন্ সূত্রে তার যাতায়াত ছিল, তা জানা যায়নি। অক্ষয় মণ্ডলের নামে হুলিয়া জারী হয়েছে; কিন্তু সে এখনো ধরা পড়েনি, কর্পূরের মত উবে গেছে।
‘থানা থেকে ফেরার সময় ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম, “পুরো বাড়িটা তাহলে আমি দখল করতে পারি?”
‘দারোগাবাবু বললেন, “স্বচ্ছন্দে। আসামী যখন ফেরার হবার আগে আপনাকে তার বাড়ির হেপাজতে রেখে গেছে, তখন আপনি থাকবেন বৈকি। তবে একটা কথা, যদি আসামীর সাড়াশব্দ পান, তৎক্ষণাৎ থানায় খবর দেবেন”
‘তারপর প্রায় বছরখানেক ভারি আরামে কেটেছে। স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এলাম, সারা বাড়িটা দখল করে দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে বাস করছি। বাড়ির ভাড়া মাসে মাসে অক্ষয় মণ্ডলের খাতায় জমা করে দিই। তার টেবিল চেয়ার ইত্যাদি ব্যবহার করি বটে কিন্তু আলমারি বাক্স কাবার্ডে হাত দিই না, পুলিস খানাতল্লাশ করার পর যেমনটি ছিল তেমনি আছে।
‘হঠাৎ মাস দুই আগে এক ফ্যাসাদ উপস্থিত হল। সকালবেলা নীচের ঘরে বসে কাগজ পড়ছি, একজন অপরিচিত লোক এল, তার সঙ্গে একটি স্ত্রীলোক। ভদ্রশ্রেণীর মধ্যবয়স্ক পুরুষ, স্ত্রীলোকটি সধবা। পুরুষ স্ত্রীলোকটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “এ হচ্ছে অক্ষয় মণ্ডলের স্ত্রী, আমি ওর বড় ভাই। এতদিন আমি ওকে পুষেছি, কিন্তু আর আমার পোষবার ক্ষমতা নেই। এবার ও স্বামীর বাড়িতে থাকবে। আপনাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।”
‘মাথায় বজ্রপাত। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। তারপর বুদ্ধি গজালো, বললাম, “অক্ষয়বাবুর স্ত্রী আছেন, তা কোনদিন শুনিনি। যদি আপনাদের কথা সত্যি হয়, আপনি আদালতে গিয়ে নিজের দাবি প্রমাণ করুন, তারপর দেখা যাবে।”
‘কিছুক্ষণ বকাবকি কথা-কাটাকাটির পর তারা চলে গেল। আমার সন্দেহ হল এরা দাগাবাজ জোচ্চোর, ছলছুতো করে বাড়িটা দখল করে বসতে চায়। আজকাল বাসাবাড়ির যে রকম ভাড়া দাঁড়িয়েছে, ফোকটে বাসা পেলে কে ছাড়ে!
‘থানায় গিয়ে খবরটা জানিয়ে এলাম। দারোগাবাবু বললেন, “অক্ষয় মণ্ডলের স্ত্রী আছে কিনা আমাদের জানা নেই। যাহোক, আমার যদি আসে, ছলছুতো করে থানায় নিয়ে আসবেন। আমরাও বাড়ির ওপর নজর রাখব।”
‘আমার পিস্তল আছে, তাছাড়া একটা কুকুর পুষেছি। হিংস্র পাহাড়ী কুকুর, নাম ভুটো; আমার হাতে ছাড়া কারুর হাতে খায় না। আমি ব্যাঙ্কে যাবার সময় তার শেকল খুলে দিই, রাত্তিরে তাকে ছেড়ে দিই, সে বাড়ি পাহাড়া দেয়। ভুটো ছাড়া থাকতে বাড়িতে চোর-ছাঁচড় ঢোকার ভয় নেই, ভুটো তাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। তবু এই ঘটনার পর মনে একটা অস্বস্তি লেগে রইল। অক্ষয় মণ্ডল লোক ভাল নয়, হয়তো নিজে আড়ালে থেকে কোনো কুটিল খেলা খেলছে।
‘দিন দশেক পরে একখানা বেনামী চিঠি পেলাম, “পাড়া ছেড়ে চলে যাও, নইলে বিপদে পড়বে।”–পাড়া মানেই বাড়ি। থানায় গিয়ে চিঠি দেখালাম। দারোগাবাবু বললেন, “চেপে বসে থাকুন, বড়বেন না। আপনার বাসার ওপর পাহারা বাড়িয়ে দিচ্ছি।”
‘তারপর থেকে এই দেড় মাস আর কেউ আসেনি, উড়ো চিঠিও পাঠায়নি। এখন বেশ নিরাপদ বোধ করছি। কিন্তু একটি সমস্যার উদয় হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্যই আপনার কাছে আসা। দারোগাবাবুর কাছে যেতে পারতাম, কিন্তু তিনি হয়তো এমন উপদেশ দিতেন যা আমাদের পছন্দ হত না।
‘ব্যাপারটা এই : ব্যাঙ্ক থেকে আমার এক মাসের ছুটি পাওয়া হয়েছে। আমার স্ত্রীর অনেক দিন থেকে তীর্থে যাবার ইচ্ছে। হরিদ্বার, হৃষিকেশ এইসব। ব্যাঙ্কের একটি সহকর্মীও আমার সঙ্গেই ছুটি নিয়ে কুণ্ডু স্পেশালে বেড়াতে বেরুচ্ছেন, আমাকেও তিনি সঙ্গে যাবার জন্য চাপাচাপি করছেন। দল বেঁধে গেলে অনেক সুবিধে হয়। আমার স্ত্রী খুব উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন। আমার উৎসাহও কম নয়। কিন্তু–
‘যেতে হলে বাড়িতে তালা বন্ধ করে যেতে হবে। ভুটোকেও মাসখানেকের জন্যে একটা কেনেলে ভর্তি করে দিতে হবে। বাড়ি অরক্ষিত থাকবে। মনে করুন, এই ফাঁকে অক্ষয় মণ্ডলের বৌ–মানে, ওই স্ত্রীলোকটা যদি তালা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে বাড়ি দখল করে বসে, তখন আমি কি করব? অক্ষয় মণ্ডলের মৌখিক অনুমতি ছাড়া আমার তো কোনো হক নেই। তবে আমি দখলে আছি, আমাকে বেদখল করতে হলে ওদের আদালতে যেতে হবে। কিন্তু ওরা যদি দখল নিয়ে বসে, তখন আমি কোথায় যাব?
‘এই আমার সমস্যা। নিতান্তই ঘরোয়া সমস্যা। আপনার নিরীক্ষার উপযুক্ত নয়। তবু রথ-দেখা কলা-বেচা দুই-ই হবে, এই মতলবে আপনার কাছে এসেছি। এখন বলুন, বাড়িখানি রেখে আমাদের তীর্থযাত্রা করা উচিত হবে কিনা।”
ব্যোমকেশ খানিকক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে রইল, শেষ বলল, “আপনাদের তীর্থযাত্রায় বাধা দিলে পাপ হবে, আবার বাড়ি বেহাত হয়ে যাওয়াও বাঞ্ছনীয় নয়। আপনার জানাশোনার মধ্যে এমন মজবুত লোক কি কেউ নেই, যাকে বাড়িতে বসিয়ে তীর্থযাত্রা করতে পারেন?”
‘কই, সে রকম কাউকে দেখছি না। সকলেরই বাসা আছে। যাদের নেই তাদের বসাতে সাহস হয় না, শেষে খাল কেটে কুমীর আনব।’
‘তাহলে চলুন, আপনার বাসাটা দেখে আসি।’ ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়াল।
কমলবাবু উৎফুল্ল চোখে চাইলেন, ‘যাবেন! কী সৌভাগ্য! চলুন চলুন, বেশি দূর নয়–‘
‘একটু বসুন। বেশি দূর না হলেও রোদ বেশ কড়া। একটা ছাতা নিয়ে আসি।’
ব্যোমকেশ ভিতরে গিয়ে ছাতা নিয়ে এল। ছাতাটি ব্যোমকেশের প্রিয় ছাতা; অতিশয় জীর্ণ, লোহার বাঁট এবং কামানিতে মরচে ধরেছে, কাপড় বিবর্ণ এবং বহু ছিদ্রযুক্ত। এই ছাতা মাথায় দিয়ে রাস্তায় বেরুলে নিজে অদৃশ্য থেকে সন্দেহভাজন ব্যক্তির অনুসরণ করা যায়; ফুটো ফিয়ে বাইরের লোককে দেখা যায়, কিন্তু বাইরের লোক ছাতাধারীর মুখ দেখতে পায় না। সত্যান্বেষীর উপযুক্ত ছাড়া।
‘চলুন।’
লোহার বিস্কুট -২
কমলবাবুর বাসা ব্যোমকেশের বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের রাস্তা। মাঝে মাঝে এ পথ দিয়ে যাবার সময় বাড়িটি ব্যোমকেশের চোখে পড়েছে; ছোট দোতলা বাড়ি; কিন্তু একটি বিশেষত্বের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে; সমস্ত ছাদ লোহার ডাণ্ডা-ছত্রী দিয়ে ঢাকা, যেন প্রকাণ্ড একটা লোহার খাঁচা। বাইরে থেকে কোনো মতেই ছাদের ওঠা সম্ভব নয়।
‘আসুন।’
ছাতা মুড়ে ব্যোমকেশ বাড়িতে ঢুকল। কমলবাবু প্রথমে তাকে নীচের তলায় বসবার ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটি শতরঞ্জি-ঢাকা তক্তপোশ ও দু’টি ক্যাম্বিসের চেয়ার ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই। ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে চোখ ফেরাল। সে যেন একটা সূত্র খুঁজছে, কিন্তু এই নগ্নপ্রায় ঘরে কোনো অঙ্গুলিনির্দেশ পাওয়া গেল না। সে বলল, ‘নীচের তলায় আর একটা ঘর আছে, না?’
‘আছে। ঘরটা অক্ষয় মণ্ডলের আমলে ব্যবহার হত না, আমি ওটাকে রান্নাঘর করেছি। দেখবেন?’
‘দরকার নেই। আপনার স্ত্রী বোধ হয় এখন রান্নাবান্না করছেন। চলুন, ওপরতলাটা দেখা যাক।’
‘চলুন।’
ঘরের লাগাও একটা সরু বারান্দার শেষে ওপরে ওঠার সিঁড়ি, সিঁড়ির মাথায় দরজা।
দরজার মাথায় ওপরকার দেয়ালে ঘোড়ার ক্ষুরের নালের মত লোহার একটা জিনিস তিনটে পেরেকের মাঝখানে আটকানো রয়েছে। ব্যোমকেশ সেই দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছাতা তুলে সেই দিকে নির্দেশ করে বলল, ‘ওটা কি?’
‘ওটা ঘোড়ার নাল। বিলিতি কুসংস্কার অনুযায়ী দোরের মাথায় ঘোড়ার নাল টাঙিয়ে রাখলে নাকি অনেক টাকা হয়।’
ব্যোমকেশের ছাতার ডগা ঘোড়ার নালে আটকে গিয়েছিল, সে টেনে সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘এটা কি আপনি লাগিয়েছেন নাকি?’
‘না, অক্ষয় মণ্ডলের আমল থেকে আছে।’
ব্যোমকেশ ঘোড়ার নালের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। কমলবাবু ডাকলেন, ‘ভেতরে আসুন।’
ঘরের ভিতর কমলবাবুর দশ বছরের মেয়ে মেঝেয় মাদুর পেতে বসে লেখাপড়া করছিল, তার কাছে মাদুরের বাইরে একটা ভীষণদর্ষন কুকুর থাবা পেতে বসেছিল, ব্যোমকেশের পানে মণিহীন নীলাভ চোখ তুলে চাইল। কমলবাবু বললেন, ‘খুকু, যাও তোমার মাকে চা তৈরি করতে বল, আর কিছু ভাজাভুজি।’
ব্যোমকেশ একটু আপত্তি করল, কিন্তু কমলবাবু শুনলেন না। খুকু নীচে চলে গেল, ভূটো সঙ্গে সঙ্গে গেল।
অতঃপর ব্যোমকেশ ঘরটি চক্ষু দিয়ে সমীক্ষা করল। বলল, ‘এ ঘরে অক্ষয় মণ্ডলের কোনো আসবাবপত্র আছে?’
কমলবাবু বললেন, ‘ছিল, আমি পাশের ঘরে নিয়ে গেছি। খাট এবং দেরাজওয়ালা টেবিল। এই যে।’
পাশের ঘরটি অপেক্ষাকৃত বড়; জানলার দিকে খাট, অন্য কোণে টেবিল। ব্যোমকেশ টেবিলের কাছে গিয়ে বলল, ‘সেই যে পুলিসের খানাতল্লাশে লোহার মোড়ক পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো কি পুলিস নিয়ে গিয়েছে?’
‘একটা মোড়ক পুলিস নিয়ে গিয়েছিল, বাকিগুলো দেরাজে আছে।’ কমলবাবু নীচের দিকের একটা দেরাজ খুলে বললেন, ‘এই যে!’
দেরাজের পিছন দিকে কয়েকটা মোড়ক পড়ে ছিল, ব্যোমকেশ একটা বের করে নেড়েচেড়ে দেখল। আকৃতি-প্রকৃতি সিগারেট প্যাকেটের অভ্যন্তরস্থ তবকের মতই বটে। সেটা রেখে দিয়ে সে হাসিমুখে বলল, ‘ভারি মজার জিনিস তো! এর ভেতর গোটা দুই বিস্কুট রেখে সুতো দিয়ে বেঁধে দিলে নিশ্চিন্দি। চলুন, এবার ছাদটা দেখে আসা যাক।’
‘ছাদে কিন্তু কিছু নেই!’
‘তা হোক। শূন্যতাই হয়তো অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।’
‘তাহলে আসুন।’
ছাদে সত্যই কিছু নেই। লোহার ঘেরাটোপ ঢাকা ছাদটা বাঘের শূন্য খাঁচার মত দাঁড়িয়ে আছে। এক কোণে উঁচু পাদপীঠের ওপর লাল রঙের লোহার চৌবাচ্চা; এই চৌবাচ্চা থেকে বাড়িতে কলের জল সরবরাহ হয়। ব্যোমকেশ ছাদের চারিদিক সন্ধিৎসুভাবে পরিক্রমণ করে বলল, ‘ছাদটা আপনারা ব্যবহার করেন না?’
কমলবাবু বললেন, ‘বেশি গরম পড়লে ছাদে এসে শুই। বেশ নিরাপদ জায়গা, চর ঢুকবে সে উপায় নেই।’
‘হুঁ। চলুন, আমার দেখা শেষ হয়েছে।’
নীচে নেমে এলে পর খুকু এসে বলল, ‘বাবা, বসবার ঘরে চা দিয়েছি।’
নীচের তলার ঘরে পাঁপড় ভাজা ও গরম বেগুনি সহযোগে চা পান করতে করতে ব্যোমকেশ বলল, ‘থানার যে দারোগাবাবুর কাছে আপনার যাওয়া-আসা, তাঁর নাম কি?’
কমলবাবু বললেন, ‘তাঁর নামে রাখাল সরকার।’
ব্যোমকেশ মুচকি হাসল। চা শেষ করে সে ছাতা নিয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘আচ্ছা, আজ তাহলে উঠি।’
কমলবাবু বললেন, ‘কিন্তু আমাদের তীর্থযাত্রার কি হবে, যাওয়া উচিত হবে কি না, কিছু বললেন না তো।’
‘নিশ্চয় তীর্থযাত্রা করবেন। কবে থেকে আপনার ছুটি?’
‘সামনের শনিবার থেকে।’
‘তাহলে আর দেরি করবেন না, টিকিট কিনে ফেলুন। কোনো ভয় নেই, আপনার বাসা বেদখল হবে না, আমি জামিন রইলাম।–আচ্ছা, চলি।’
‘অ্যাঁ–তাই নাই! ধন্যবাদ ব্যোমকেশবাবু। চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘তার দরকার নেই, আমি এখন থানায় যাব। রাখালের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতে হবে।’
লোহার বিস্কুট -৩
শনিবার সকালবেলা কমলবাবুর বাসা থেকে পুলিসের পাহারা তুলে নেওয়া হল।
কমলবাবু ভুটোকে একটা কেনেলে রেখে এলেন। পুলিস ছাড়াও অন্য একটি পক্ষ বাসার ওপর নজর রেখেছিল, তারা সব লক্ষ্য করল।
বিকেলবেলা কমলবাবু তাঁর স্ত্রী মেয়ে এবং পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে বাসায় চাবি দিয়ে চলে গেলেন, যাবার পথে থানায় রাখালবাবুকে চাবি দিয়ে বলে গেলেন, ‘খিড়কির দোর ভেজিয়ে রেখে এসেছি। এখন আমার বরাত আর আপনাদের হাতযশ।’
সারা দিন বাড়িটা শূন্য পড়ে রইল।
রাত্রি আন্দাজ সাড়ে আটটার সময় ব্যোমকেশকে নিয়ে রাখালবাবু কমলবাবুর বাসার দিকে গেলেন। দু’জনের পকেটেই পিস্তল এবং বৈদ্যুতিক টর্চ।
সরজমিন আগে থাকতেই দেখা ছিল, পাশের বাড়ির পাঁচিল ডিঙিয়ে দু’জনে কমলবাবুর খিড়কি দিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন, খিড়কির দরজা বন্ধ করে দিয়ে পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেন। কান পেতে শুনলেন, বাড়ি নিস্তব্ধ।
রাখালবাবু পলকের জন্য দোরের মাথায় টর্চের আলো ফেলে দেখলেন, ঘোড়ার ক্ষুর যথাস্থানে আছে। তিনি তখন ফিসফিস করে বললেন, ‘চলুন, ছাদে দিয়ে অপেক্ষা করলেই বোধহয় ভাল হবে।’
ব্যোমকেশ তাঁর কানে কানে বলল, ‘না। আমি ছাদে যাচ্ছি, তুমি এই ঘরে লুকিয়ে থাকো। দু’জনেই ছাদে গেলে ছাদের দোর এদিক থেকে বন্ধ করা যাবে না, আসামীর সন্দেহ হবে।’
‘বেশ, আপনি ছাদে গিয়ে লুকিয়ে থাকুন, আমি দোর বন্ধ করে দিচ্ছি।’
ব্যোমকেশ ছাদে উঠে গেল, রাখালবাবু দরজার হুড়কো লাগিয়ে নেমে এলেন। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ঠিক নেই, এমন কি আসামী আজ নাও আসতে পারে। তিনি দোতলার ঘরের ভিতর ঢুকে দোরের পাশে লুকিয়ে রইলেন।
ছাদের ওপর ব্যোমকেশ এদিক ওদিক ঘুরে জলের চৌবাচ্চা থেকে দূরের একটা আল্সের পাশে গিয়ে বসল। আকাশে চাঁদ নেই, কেবল তারাগুলো ঝিকমিক করছে। ব্যোমকেশ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা। বনের মধ্যে ছাগল বা বাছুর বেঁধে মাচার ওপর বসে বাঘের প্রতীক্ষা করার মত। রাত্রি দুটো বাজতে যখন আর দেরি নেই, তখন রাখালবাবুর মন বদ্ধ ঘরের মধ্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল : আজ আর শিকার আসবে না। ঠিক এই সময় তিনি দোরের বাইরে মৃদু শব্দ শুনতে পেলেন; মুহূর্তে তাঁর স্নায়ুপেশী শক্ত হয়ে উঠল। তিনি নিঃশব্দে পকেট থেকে পিস্তল বার করলেন।
যে মানুষটি নিঃসাড়ে বাড়িতে প্রবেশ করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসেছিল, তার বাঁ হাতে ছিল একটি ক্যাম্বিসের থলি, আর ডান হাতে ছিল লোহা-বাঁধানো একটি ছড়ি। ছড়ির গায়ে তিনি হাত লম্বা মুগার সুতো জড়ানো, মাছ-ধরা ছিপের গায়ে যেমন সুতো জড়ানো থাকে সেই রকম।
লোকটি দোরের মাথার দিকে লাঠি বাড়িয়ে ঘোড়ার ক্ষুরটি নামিয়ে আনল, তারপর মুগার সুতোর ডগায় সেটি বেঁধে নিয়ে তেতলার সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে গেল। দু’টি মানুষ যে বাড়ির দু’ জায়গায় ওৎ পেতে আছে, তা সে জানতে পারল না।
ছাদের দরজায় একটু শব্দ শুনে ব্যোমকেশ সতর্ক হয়ে বসল। নক্ষত্র আলোয় একটি ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল, সোজা ট্যাঙ্কের কাছে গিয়ে আল্সের ওপর উঠে ট্যাঙ্কের মাথায় চড়ল। ধাতব শব্দ শোনা গেল। সে ট্যাঙ্কের ঢাকনি খুলে সরিয়ে রাখল, তারপর লাঠির আগায় সুতো-বাঁধা ঘোড়ার নাল জলের মধ্যে ডুবিয়ে দিল।
লোকটা যেন আবছা অন্ধকারে বসে ছিপ ফেলে চুনো মাছ ধরছে। ছিপ ডোবাচ্ছে আর তুলছে। মাছগুলি ব্যাগের মধ্যে পিরে আবার ছিপ ফেলছে।
কুড়ি মিনিট পরে লোকটি মাছ ধরা শেষ করে ট্যাঙ্ক থেকে নামল। এক হাতে ব্যাগ অন্য হাতে ছিপ নিয়ে যেই পা বাড়িয়েছে, অমনি তার মুখের উপর দপ করে টর্চ জ্বলে উঠল, ব্যোমকেশের ব্যঙ্গ-স্বর শোনা গেল, ‘অক্ষয় মণ্ডল, কেমন মাছ ধরলে?’
অক্ষয় মণ্ডলের পরনে খালি প্যান্ট ও হাফ-সার্ট, কালো মুস্কো চেহারা। সে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আস্তে আস্তে থলিটি নামিয়ে রেখে ক্ষিপ্রবেগে পকেটে হাত দিল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যোমকেশের টর্চ গদার মত তার চোয়ালে লাগল, অক্ষয় মণ্ডল ছাদের ওপর চিতিয়ে পড়ল।
রাখালবাবু নীচে থেকে উঠে এসেছিলেন, তিনি অক্ষয় মণ্ডলের বুকের ওপর বসে বললেন, ‘ব্যোমকেশদা, এর পকেটে পিস্তল আছে, বের করে নিন।’
ব্যোমকেশ অক্ষয় মণ্ডলের পকেট থেকে পিস্তল বার করে নিজের পকেটে রাখল। রাখালবাবু আসামীর হাতে হাতকড়া পরিয়ে বললেন, ‘অক্ষয় মণ্ডল, হরিহর সিংকে খুন করার অপরাধে তোমাকে গ্রেপ্তার করলাম।’
ব্যোমকেশ অক্ষয় মণ্ডলের থলি থেকে কয়েকটা ভিজে লোহার প্যাকেট বার করে তার ওপর টর্চের আলো ফেলল। ‘বাঃ! এই যে, যা ভেবেছিলাম তাই। লোহার মোড়কের মধ্যে চকচকে বিদেশী সোনার বিস্কুট।’
লোহার বিস্কুট -৪
পরদিন সকালবেলা সত্যবতী ব্যোমকেশকে বলল, ‘ভাল চাও তো বল, কোথায় রাত কাটালে?’
ব্যোমকেশ কাতর স্বরে বলল, ‘দোহার ধর্মাবতার, রাখাল সাক্ষী–আমি কোনো কুকার্য করিনি।’
‘শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। গল্পটা বলবে?’
‘বলব, বলব। কিন্তু আগে আর এক পেয়ালা চা দিতে হবে। এক পেয়ালা চা খেয়ে রাত জাগার গ্লানি কাটেনি।’
সত্যবতী আর এক পেয়ালা কড়া চা এনে ব্যোমকেশের সামনের চেয়ারে বসল, ‘এবার বল, টর্চটা ভাঙলে কি করে? মারামারি করেছিলে?’
ব্যোমকেশ বলল, ‘মারামারি নয়, শুধু মারা।’ চায়ে একটি চুমুক দিয়ে সে বলতে আরম্ভ করল:
‘অক্ষয় মণ্ডল সোনার চোরাকারবার করে অনেক টাকা করেছিল। নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ভদ্র পাড়ায় একটি বাড়ি করেছিল, বাড়ির ছাদ লোহার ডাণ্ডা-ছত্রী দিয়ে এমনভাবে মুড়ে রেখেছিল যে ওদিক দিয়ে বাড়িতে চোর ঢোকার উপায় ছিল না। ছাদটাকে নিরাপদ করা তার বিশেষ দরকার ছিল।
‘অক্ষয় মণ্ডলের পেশা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে যেসব চোরাই সোনা আসে তাই সংগ্রহ করা এবং সুযোগ মত বাজারে ছাড়া। সে বাড়িতেই সোনা রাখত, কিন্তু লোহার সিন্দুকে নয়। সোনা লুকিয়ে রাখার এক বিচিত্র কৌশল সে বার করেছিল।
‘অক্ষয় মণ্ডল বাড়িতে একলা থাকত; তার স্ত্রী আছে কিনা তা এখনো জানা যায়নি। সে পাড়ার লোকের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করত না, কিন্তু পাছে পড়শীরা কিছু সন্দেহ করে, তাই কমল দাস নামে একটা ভদ্রলোককে নীচের তলায় একটি ঘর ভাড়া দিয়েছিল। বাজারে সোনা ছাড়বার জন্য সে কয়েকজন লোক রেখেছিল, তাদের মধ্যে একজনের নাম হরিহর সিং।
‘হরিহর সিং বোধহয় অক্ষয় মণ্ডলকে ফাঁকি দিচ্ছিল। একদিন দু’জনের ঝগড়া হল, রাগের মাথায় অক্ষয় মণ্ডল হরিহর সিংকে খুন করল। তারপর মাথা ঠাণ্ডা হলে তার ভাবনা হল, মড়াটা নিয়ে সে কি করবে। একলা মানুষ, ভদ্র পাড়া থেকে মড়া পাচার করা সহজ নয়। সে স্থির করল, মড়া থাক, বাড়িতে যা সোনা আছে, তাই নিয়ে সে নিজে ডুব মারবে।
‘কিন্তু সব সোনা সে নিয়ে যেতে পারল না। সোনা ধাতুটাও বিলক্ষণ ভারি, লোহার চেয়েও ভারি। তোমরা স্ত্রী-জাতি সারা গায়ে সোনার গয়না বয়ে বেড়াও, কিন্তু সোনার ভার কত বুঝতে পারো না। দশ হাত কাপড়ে কাছে নেই।’
সত্যবতী বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, তারপর বল।’
‘অক্ষয় মণ্ডল ডুব মারবার কয়েকদিন পরে লাশ বেরুল; পুলিস এল, কিন্তু খুনের কিনারা হল না। অক্ষয় মণ্ডল খুন করেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সে নিরুদ্দেশ। কমলবাবু সারা বাড়িটা দখল করে বসলেন।
‘অক্ষয় মণ্ডল নিশ্চয় কলকাতাতেই কোথাও লুকিয়ে ছিল, কয়েক মাস চুপচাপ রইল। কিন্তু বাড়িতে যে-সোনা লুকোনো আছে–যেগুলো সে সরাতে পারেনি, সেগুলো উদ্ধার করতে হবে। কাজটি সহজ নয়। কমলবাবুর স্ত্রী এবং মেয়ে সর্বদা বাড়িতে থাকে, তাছাড়া একটি ভয়ঙ্কর হিংস্র কুকুর আছে। অক্ষয় মণ্ডল ভেবে-চিন্তে এক ফন্দি বার করল।
‘একটি স্ত্রীলোককে বউ সাজিয়ে এবং একটা পেটোয়া লোককে তার ভাই সাজিয়ে অক্ষয় মণ্ডল কমলবাবুর কাছে পাঠাল। বউকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। অক্ষয় মণ্ডল ফেরারী খুনী হতে পারে, কিন্তু তার বউ তো কোনো অপরাধ করেনি। কমলবাবু কিন্তু শুনলেন না, তাদের হাঁকিয়ে দিলেন। অক্ষয় মণ্ডল তখন বেনামে চিঠি লিখে ভয় দেখাল, কিন্তু তাতেও কোনো ফল হল না। কমলবাবু নড়লেন না।
‘অক্ষয় মণ্ডল তখন অন্য রাস্তা ধরল।
‘আমার বিশ্বাস ব্যাঙ্কের যে সহকর্মিটি কমলবাবুকে তীর্থে যাবার জন্য ভজাচ্ছিলেন, তার সঙ্গে অক্ষয় মণ্ডলের যোগাযোগ আছে। দু’-চার দিনের জন্যও যদি কমলবাবুকে সপরিবারে বাড়ি থেকে তফাৎ করা যায়, তাহলেই অক্ষয় মণ্ডলের কার্যসিদ্ধি। কাজটা সে বেশ গুছিয়ে এনেছিল, কিন্তু একটা কারণে কমলবাবুর মনে খটকা লাগল; বাড়ি যদি বেদখল হয়ে যায়! তিনি আমার কাছে পরামর্শ নিতে এলেন।
‘তার গল্প শুনে আমার সন্দেহ হল বাড়িটা ওপর, আমি বাড়ি দেখতে গেলাম। দেখাই যাক না। অকুস্থলে গেলে অনেক ইশারা-ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
‘গেলাম বাড়িতে। কড়া রোদ ছিল, তাই ছাতা নিয়ে গিয়েছিলাম। দোতলায় উঠে দেখলাম, দোরের মাথায় ঘোড়ার নাল তিনটে পেরেকের মাঝখানে আলগাভাবে আটকানো রয়েছে। ঘোড়ার নালটা এক নজর দেখলে ঘোড়ার নাল বলেই মনে হয় বটে, কিন্তু ঠিক যেন ঘোড়ার নাল নয়। আমি ছাতাটা সেইদিকে বাড়িয়ে দিলাম, অমনি ছাতাটা আপনা থেকেই গিয়ে ঘোড়ার নালে জুড়ে গেল।
‘বুঝলাম, ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম, ঘোড়ার নাল নয়, একটি বেশ শক্তিমান চুম্বক–ছাতার লোহার বাঁট পেয়ে টেনে নিয়েছে। প্রশ্ন করে জানলাম চুম্বকটা অক্ষয় মণ্ডলের। মাথার মধ্যে চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল–কেন? অক্ষয় মণ্ডল চুম্বক নিয়ে কি করে? দোরের মাথায় টাঙিয়েই বা রেখেছে কেন, যাতে মনে হয় ওটা ঘোড়ার নাল? মনে পড়ে গেল, পুলিসের খানাতল্লাশে দেরাজের মধ্যে কয়েকটা লোহার মোড়ক পাওয়া গিয়েছিল। রহস্যটা ক্রমশ পরিষ্কার হতে লাগল।
‘তারপর যখন ঘেরাটোপ লাগানো ছাদে গিয়ে জলের ট্যাঙ্ক দেখলাম, তখন আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। চুম্বক যত জোরালোই হোক, সোনাকে টানবার ক্ষমতা তার নেই। তাই সে সোনার বিস্কুট লোহার প্যাকেটে মুড়ে ট্যাঙ্কের জলে ফেলে দেয়। তারপর যেমন যেমন দরকার হয়, ট্যাঙ্কে চুম্বকের ছিপ ফেলে জল থেকে তুলে আনে। হরিহর সিংকে খুন করে পালাবার সময় সে সমস্ত সোনা নিয়ে যেতে পারেনি। এখন বাকি সোনা উদ্ধার করতে চায়। পালাবার সময় যে ভাবেনি যে ব্যাপারটা এত জটিল হয়ে উঠবে।
‘যাহোক, সোনার সন্ধান পেলাম; সমুদ্রের তলায় শুক্তির মধ্যে যেমন মুক্তো থাকে, ট্যাঙ্কের তলায় তেমনি লোহার পাতে মোড়া সোনা আছে। কিন্তু কেবল উদ্ধার করলেই তো চলবে না, খুনী আসামীকে ধরতে হবে। আমি কমলবাবুকে বললাম, আপনি সপরিবারে তীর্থযাত্রা করুন। তারপর রাখালের সঙ্গে পরামর্শ করে ফাঁদ পাতার ব্যবস্থা করলাম।
‘কাল সকালে কমলবাবুরা তীর্থযাত্রা করলেন। বাড়ির ওপর অক্ষয় মণ্ডল নজর রেখেছিল, সে জানতে পারল, রাস্তা সাফ।
‘কাল সন্ধ্যের পর রাখাল আর আমি বাড়িতে গিয়ে আড্ডা গাড়লাম। কালই যে অক্ষয় মণ্ডল আসবে এতটা আশা করিনি, তবু পাহারা দিতে হবে। বলা তো যায় না। রাত্রি দুটোর সময় শিকার ফাঁদে পা দিল। তারপর আর কি! টর্চের একটি ঘায়ে ধরাশায়ী।’
সত্যবতী ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কত সোনা পাওয়া গেল?’
সিগারেট ধরিয়ে ব্যোমকেশ বলল, ‘সাতান্নটি লোহার মোড়ক, প্রত্যেকটি মোড়কের মধ্যে দু’টি করে সোনার বিস্কুট, প্রত্যেকটি বিস্কুটের ওজন পঞ্চাশ গ্রাম। কত দাম হয় হিসেব করে দেখ।’
সত্যবতী কেবল একটি নিশ্বাস ফেলল।