ওর বাবা-মা নেই । কার অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন এক মাস হল ।
এর পর থেকে বাসাতে থাকতে ভালো লাগে না ওর মোটেও ।
এই একসপ্তাহ হল শোকের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ক্লাসেও আসা শুরু করেছে – এর মাঝেই ভুল ভাল দেখতে শুরু করল ?
ক্লাস রুমের মাঝে কাটা হাত পড়ে থাকার কোনই কারণ নেই ।
হাতটা আসল হাত নাকি ডামি দেখা দরকার ।
কাজেই মেঝে থেকে আলতো করে ধরে তুলে ও টেবিলের ওপর ওটাকে ।
এবং কাছ থেকে দেখতে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় ।
হাতটা কোন একজন মেয়ের ।
তবে সেটা সমস্যা নয় । বাম হাত এটা ।
আর কানি আঙ্গুলে চুপচাপ বসে থাকা নীল রঙের পাথরের আংটিটা ওর খুব ভালো করেই চেনা ।
এটা রিনিতার হাত !
ওর অন্যতম প্রিয় বন্ধু রিনিতার হাত !
অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে নীরব ।
ঠিক এই সময় ক্লাসে এসে ঢোকে সুমি ।
এক সেকেন্ড চোখে চোখে তাকিয়ে থাকে ওরা ।
পরমুহূর্তেই রিনিতার হাতটা চোখে পড়ে যায় সুমির ।
তীক্ষ্ণ চিৎকারে ক্লাসরুমটা ভরিয়ে দেয় রিনিতার বেস্ট ফ্রেন্ড সুমি ।
পুলিশ জেরা করছে নীরবকে প্রায় এক ঘন্টা ধরে ।
নীরবের মনে হয় কয়েক যুগ পার হয়ে যেতে শেষ হল ওদের জেরা ।
‘রিনিতার সাথে তোমার শেষ দেখা কবে ?’ ‘রিনিতা আর তোমার সম্পর্ক কেমন’ ‘তুমি এত আগে ক্লাসে কি করছিলে’ ‘তুমি কেন হাতটা পেয়ে পুলিশে না জানিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলে ?’ ‘রিনিতার সাথে তোমার শেষ দেখা কবে ?’
ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন – শতবার । অবশেষে যেন ওদের মনে হল নীরবকে ছাড়া যায় ।
তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বের হয়ে আসে নীরব ।
রিনিতাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি ।
ছোট্ট একটা শহর ।
কোনকিছুই চাপা থাকে না ।
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নীরবের মনে হয় প্রত্যেকে ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।
‘ছেলেটার ব্যাগে একটা হাত ছিল । ওরই বান্ধবীর হাত ।’ – দুটো অল্পবয়েসী মেয়ে যেতে যেতে এই কথা বলে , স্পষ্ট শুনে নীরব ।
চমৎকার ! – মনে মনে না ভেবে পারে না নীরব ।
গল্পটার শাখা প্রশাখা বানিয়েছে ভালোই ।
ক্লান্ত পায়ে এসে নিজের বাসাটার দরজা খুলে ।
এই বাড়িটা মাত্র এক মাস আগেই ওর জন্য ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আশ্রয় ।
পাহাড়ী রাস্তা ধরে আসছিলেন ওঁরা সে রাতে ।
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাবা-মা দুইজনকে নিয়ে গাড়িটি পড়ে যায় খাদ বেয়ে ।
খবরটা পায় নীরব মোবাইলে ।
প্রতিবেশীরা ওকে ওদের বাগানে পড়ে থাকতে দেখে ।
মাথায় আঘাত পেয়েছে ভালোই ।
সবাই বোঝে – বাবা-মার মৃত্যু সংবাদ সহ্য করতে না পেরে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে ছেলেটা ।
তবে কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থেকে আর সহ্য হয় না নীরবের ।
আবারও কলেজে যেতে শুরু করে ।
এর একসপ্তাহের মাঝেই ঘটে গেল এই দুর্ঘটনা ।
এই মুহূর্তে অবশ্য বাসার দরজা খুলে ওর মন কিছুটা ভালো হয়ে যায় ।
‘হোম – সুইট হোম ।’ বিড় বিড় করে বলে ।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়ির চেয়ে আরামদায়ক আর কি হতে পারে ?
বাবা-মার ঘরের দিকে চোখ পড়তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে ওর বুক থেকে ।
এবং একরাশ সন্দেহ দানা বাঁধে সেই সাথে ।
বাবা-মার মৃত্যু পর থেকেই এই কথাটা ভাবাচ্ছে ওকে ।
তৌফিক ওমর চাচাকে মনে করার চেষ্টা করে ও খুব করে ।
কিন্তু সেই ছোট্ট বেলায় একবার দেখা চাচার চেহারা ভালো করে মনে আসে না ওর কিছুতেই ।
ওমর চাচা ছিলেন বাবার সৎ ভাই ।
এক এবং অদ্বিতীয় জীবিত আত্মীয় ।
দুর্বিনীত, নিষ্ঠুর এবং বেপরোয়া মানুষ ছিলেন ওমর চাচা ।
এবং গত পনের বছর ধরে তিনি নিখোঁজ ।
ওমর চাচাকে নিয়ে অনেক কল্পকথাই ছড়ানো হয়েছে এর পরে ।
কেউ বলে তিনি ইউরোপে চলে গেছেন ।
কেউ বলে, না – তিনি আছেন জাপানে – সোর্ডফাইটে নাকি তিনি একজন গুরু ।
বক্তারা নিজ চোখে দেখে ওই সব দেশ থেকে ফোন দিয়েছিলেন ।
তবে ওমর চাচা দেন নি একটা ফোনকলও । বাবাকে ঘৃণা করতেন তিনি ।
তবে এখন নীরবের ঘোর সন্দেহ হয় ।
চাচা কি আসলেই বাইরে এখনও ?
নাকি সব সঞ্চয় উড়িয়ে দাদার বিশাল সম্পত্তি হাতানোর জন্যই বাবা-মাকে সরিয়ে দিয়েছেন দেশে ফিরে ?
এখন রিনিতার মৃত্যুর সাথেই বা কেন নীরবের সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে ?
পেছনে কি ওমর চাচার হাত আছে ?
নীরবকে ফাঁসিয়ে শেষ বাঁধাটা দূর করে দিতে চান ওমর চাচা ?
ভাবনার ডালপালা বন্ধ করে ফ্রিজের দিকে আগায় নীরব ।
কোল্ড ড্রিংকস খাওয়া যেতে পারে একটা । যা দিন গেছে !
ডালা খুলেই স্থির হয়ে যায় ও ।
ভেতরে সুন্দর করে একটা প্লেটে বসানো হৃৎপিন্ডটা মানুষের – বুঝতে মোটেও সমস্যা হয় না ওর ।
কার – সেটাও বুঝে যায় নীরব ।
রিনিতার !
ঘন ঘন কলিং বেল পড়ে এই সময় বাসায় ।
পুলিশ ?
সাবধানে দরজা খুলে নীরব ।
সুমি ।
ফ্যাকাসে চেহারা আর ফর্সা গাল দুটোতে একটা ধারা দেখেই বুঝতে পারে ও – কাঁদছিল এতক্ষণ ।
‘ভেতরে আসতে পারি ?’
‘নিশ্চয় ।’ সম্বিত ফিরে পায় নীরব । পুলিশের ভয়ে মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার যোগাড় হয়েছিল ওর ।
‘রিনিতার ব্যাপারে কিছু কথা ছিল ।’ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে সুমি ।
দরজা লাগাতে গিয়েও বাইরে তাকিয়ে থাকে নীরব ।
জংলামত জায়গাতে ক্রুর দৃষ্টিতে এদিকে তাকিয়ে আছে একজন মানুষ !
ওমর চাচা না ?
আবারও ভালো মত তাকায় নীরব ।
দেখা যায় না কাওকে ওখানে ?
‘কি দেখছ ?’ ওর পাশে এসে জানতে চায় সুমি ।
‘না – কিছু না ।’ দরজা লাগায় নীরব । ‘ভেতরে চলো ।’
সোফায় বসে দুইহাঁটু একসাথে লাগিয়ে একটু একটু কাঁপে মেয়েটা ।
‘রিনিতার ব্যাপারে কিছু একটা বলতে এসেছিলে ।’
‘ও -’ হঠাৎ যেন মনে পড়ে সুমির । ‘গোটা শহর তোমাকে সন্দেহ করে রিনিতার খুনী হিসেবে ।’
‘অথচ – আমি খুনটা করি নি !’ গলা চড়ে যায় নীরবের ।
আহত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় সুমি ।
‘আমি জানি – খুনটা তুমি করনি । কারণ – আমিই শেষ ব্যক্তি – যে রিনিতাকে দেখেছিল ।’ দুই হাতে মুখ ঢাকে ও ।
‘আমাকে খুলে বল সব, সুমি ।’ ওর পাশে গিয়ে বসে নীরব । ‘নির্ভয়ে বলতে পারো ।’
‘সেদিন ও আমার বাসায় এসেছিল । গত শুক্রবারের আগের শুক্রবার । তোমাদের ফ্যামিলির দুর্ঘটনার তখন মাত্র দুই সপ্তাহ । প্রায়ই রিনিতা আসত আমার বাসায় এই সময়টায় । আরেকটা জায়গায় যেত ও । হাসপাতালে । তোমাকে দেখতে । ওরা বলেছিল ওই শুক্রবারে তোমাকে রিলিজ দেবে । রিনিতা আমার কাছে এসেছিল পরামর্শ করতে । ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল । ’
ইতস্তত করে সুমি । কাজেই প্রশ্ন করতেই হল নীরবকে, ‘কি বিষয়ে ?’
‘উম -’ চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলে সুমি, ‘তোমাকে ও ভালোবাসত – সেটা বলবে কি না সে ব্যাপারে ।’
স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সুমির দিকে তাকিয়ে থাকে নীরব ।
রিনিতাকে ওরও ভালো লাগত । কিন্তু এখন আর সে কথায় কাজ কি ?
খুনীর প্রতি প্রচন্ড একটা ক্রোধ অনুভব করে ও ।
‘কিন্তু ওই শুক্রবার আমি ছাড়া পাই নি । হঠাৎ ব্লাড প্রেশার ভয়ানক মাত্রায় কমে যাওয়ায় ডাক্তাররা বলেছিলেন আর দুই দিন থেকে যেতে ।’ হঠাৎ মনে পড়ে যায় নীরবের ।
‘আমি জানি তুমি খুনটা কর নি, নীরব ।’ চোখ মোছে সুমি । ‘কিন্তু খুনীকে আমি ধরবই । তুমি আছ আমার সাথে ?’
‘অবশ্যই !’ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় নীরব, ‘রিনিতা আমারও খুব ভালো বন্ধু ছিল । তাছাড়া সব সন্দেহের তীর আমার দিকেই আসছে । আমার এই রহস্যের সমাধান করতেই হবে ।’
‘রিনিতার সাথে ঝগড়া ছিল একটা ছেলেরই । তবে ওই ছেলে ওকে মেরে ফেলবে একেবারে সেটাও বিশ্বাস করতে পারি না ।’ বলে সুমি ।
‘কার কথা বলছ ?’ ভ্রু কুঁচকায় নীরব ।
‘রিফাত ।’ দুই হাত একসাথে লাগিয়ে বলে সুমি, ‘রিফাত আর ওর দলবল রিনিতাকে খুবই উত্যক্ত করত মনে আছে ?’
‘হুঁ । মাত্র একমাসই তো যাই না ক্লাসে । মনে আছে সবই । ’
‘না – আরেকটু ঘটনা আছে ।’ ওকে থামিয়ে দেয় সুমি । ‘তুমি তখন হাসপাতালে । ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যাথা নিয়ে পড়ে আছ । রিনিতার সাথে একদিন একটূ বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলে রিফাত ।’
‘তারপর ?’ উৎসুক হয়ে জানতে চায় নীরব ।
‘ওকে গোটা ক্লাসের সামনে থাপ্পড় দেয় রিনিতা ।’
‘এতটুকুর জন্যই খুন করে ফেলবে – রিফাতকে আমার এমন ম্যানিয়াক বলেও মনে হয় না ।’ মাথা নাড়ে নীরব । ‘তুমি ভেব না –পিছে যে আছে তাকে আমরা ধরবই ।’
হঠাৎ-ই উঠে দাঁড়ায় সুমি । ‘ফ্রিজে ঠান্ডা পানি আছে ?’
নীরব মাথা হাল্কা ঝাঁকাতেই সোজাসুজি ফ্রিজের দিকে হাঁটা দেয় ও । বাধা দেয়ার সময় পায় না নীরব ।
ড্রইং ডাইনিং একসাথে ওদের । মাঝে একটা পর্দা থাকে তবে এখন সেটা সরানো ।
ফ্রিজের ডালা সরিয়ে পানির বোতল নিতে গিয়েই থমকে যায় সুমি ।
বুঝে ফেলেছে ? – সরু চোখে তাকিয়ে থাকে নীরব ।
সুমিকে ভুল বুঝতে দেওয়া যাবে না । রহস্যটা উদঘাটন করতেই হবে ।
ফিরে এসে ওর দিকে কিভাবে জানি তাকায় ! সন্দেহ ?
‘ফ্রিজের ভেতর কেমন গোস্ত পচা গন্ধ ।’ কথার কথা এভাবে বলে সুমি ।
‘কি জানি !’ অস্বীকার করে নীরব ।
‘ইশ ! একয়দিন ধোয়া হয় নি, না ?’ এতক্ষণে সুমির চোখের দৃষ্টিটা চেনে নীরব । মমতা । ‘ধুবেই বা কি ? জীবনে এসব করেছ নাকি ? আমি এসে একদিন ধুয়ে দেব । ঠিক আছে ?’
হাসে নীরব ।
এই সময় মোবাইলটা বেজে ওঠে । সোফার কাছ থেকে আসছে রিংটোন ।
সুমির হাতব্যাগের ভেতর থেকে ।
কলটা রিসিভ করে ওপাশের কথা শুনেই হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায় সুমির । সারা শরীর থর থর করে কাঁপে ওর ।
‘কি হয়েছে ?’ ওকে ধরে ফেলে নীরব ।
‘রিফাতের লাশ পেয়েছে ওরা পার্কের কোণে । কেউ ওর মাথায় বাড়ি দিয়ে বের করে দিয়েছে ঘিলু !’
সুমি দ্রুত বাসায় চলে যায় ।
আংকেল আন্টি টেনশনে ছিলেন । ফোন করে ডেকে নিয়েছেন ওকে ।
ওদের ক্লাসেরই দুইজন খুন হয়ে গেল – কাজেই ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি ।
তবে সুমি ফোন রিসিভ করার পর থেকেই ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে নীরবের পিঠ বেয়ে ।
বাবার আলমারি থেকে পিস্তলটা বের করে এনেছে ।
ওমর চাচার প্রতি সন্দেহটা আরও বেড়ে যাচ্ছে ওর ।
ওকে ছায়ার মত ফলো করছে একজন মানুষ – এটা নিঃসন্দেহ । সুমির ঢোকার সময়ই ব্যাপারটা বোঝে ও ।
ওমর চাচা বলেই মনে হয় ওর । যদিও চাচার চেহারা এতদিন পরে ও বিস্মৃত ।
পার্কটা পুলিশ স্টেশন আর ওর বাসার মাঝে ।
আজ পার্কটাকে শর্টকাট হিসেবে বেছে নিয়েছিল নীরব ।
কেউ না কেউ ওকে পার্কে ঢুকতে এবং বের হতে তো দেখেছে অবশ্যই ।
অর্থাৎ এই কেসেও ফাঁসানো যায় নীরবকে – অনায়াসেই ।
*
তবে মাথা যতদূর সম্ভব ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে নীরব ।
এতদিন পরে ওর চাচা কয়েকটা খুন করে ওদের বিশাল পারিবারিক সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে চাচ্ছে – এটা কেউই বিশ্বাস করবে না ।
আরেকটা প্রশ্ন ওর মাথায় ধাক্কা দেয় ।
ওমর চাচা ওর বাসার ভেতর ঢুকল কি করে ?
রিনিতা কিভাবে মারা গেছে বুঝতে পারছে নীরব ।
নীরবের শুক্রবারে বের হওয়ার কথা ছিল হাসপাতাল থেকে ।
বাসার ওপর চোখ রেখেছিল ওমর চাচা ।
রিনিতাকে এদিকে আসতে দেখে ভেতরে ঢুকে যায় খুনী ।
কলিং বেল বাজাতেই নিজের পরিচয় দিতে রিনিতাও সন্দেহের কারণ না দেখে ভেতরে ঢুকে ।
বাবা-মা মৃত । নীরব হাসপাতালে ।
কাজেই একজন আত্মীয় থাকতেই পারে ওর সাথে ।
তখনই রিনিতাকে একা বাগে পেয়ে খুন করে ওমর চাচা । তারপর ছিন্নভিন্ন লাশটা থেকে হৃৎপিন্ডটা বের করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে নিশ্চয় ?
আর হাতটা – হাতটা হয়ত আগে ভাগেই এসে ক্লাসরুমে এনে রেখেছিল চাচা । সাত দিন পর ।
সাতদিন ঠান্ডায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে নিশ্চয় রিনিতার শরীর ।
আর এই সাতদিন ওকে ফলো করে নীরবের আগে আগে ক্লাসে যাওয়ার অভ্যাস সম্পর্কে ভালো মতই জেনে গেছিল চাচা ।
হতাশা চেপে ধরে নীরবকে ।
চাচার চক্রান্তে আজ ওকে দুটো খুনের জন্য সন্দেহ করা হচ্ছে – যার মাঝে একজন ওর খুব প্রিয় একটা মানুষ ।
অথচ প্রমাণ করার জন্য কিছু বের করতে পারছে না নীরব ।
পুলিশ ভাগ্যিস এখনও ভালো মত খেয়াল করেনি ব্যাপারটা । তাহলে কাজ হয়ে যেত ।
ভাগ্যিস সুমির কলিং বেলের সাথে সাথে বুদ্ধি করে ওভেনে লুকিয়ে রেখেছিল ও রিনিতার হার্টটা ।
ওভেন বন্ধ ছিল অবশ্য ।
সুমির চোখে ওই হার্ট পড়লে এতক্ষণে চৌদ্দশিকের মাঝে থাকত নীরব ।
চাচার ব্যাপারটা বুঝে ও । বাবা-মার মৃত্যুকে আর স্বাভাবিক ভাবতে পারে না এখন ।
কোনভাবে ওদের সেই রাতের দুর্ঘটনার জন্য তৌফিক ওমরই দায়ী ।
নীরবকে খুন করে ফেললে পুলিশ সন্দেহ করে বসতে পারে – তাছাড়া সম্পত্তির মালিকানা দাবী করার সময় অপ্রীতিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারে তাকে ।
সেজন্য নীরবকে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলতে দেখতে চায় কুটিল চাচা ।
মনে এইমাত্র জাগা পরের প্রশ্নটা আরও ভয়াবহ রকম ধাক্কা দেয় নীরবকে ।
‘রিনিতার লাশটা গেল কোথায় ?’
সারা বাসায় চক্কর দিতেই সব পরিষ্কার হয়ে যায় ওর কাছে ।
পেছনের দরজাটার কাঁচ ভাঙ্গা । এদিক দিয়ে নবে হাতের নাগাল পেতে পারে যে কেউ – বাসায় ঢুকে পড়া আর কঠিন কিছু নয় তখন ।
একটা তীব্র আতংক চেপে ধরে ওকে ।
খুনী এখনও বাড়ির মধ্যে থাকতে পারে ।
শক্ত করে বাবার পিস্তলটা চেপে ধরে ও ।
প্রথমেই একটা কার্ডবোর্ড দিয়ে ভাঙ্গা গ্লাসটা বন্ধ করে ।
ইচ্ছে করছে পুলিশকে ফোন করতে । নিজের বাসায় এক বিন্দু নিরাপদ নয় ও ।
তবে ওরা আসলে ফেঁসে যাবে নীরবই ।
‘ভালোই খেল দিচ্ছ চাচা মিয়া !’ – মনে মনে তিক্ততা নিয়ে ভাবে নীরব ।
দুইহাতে শক্ত করে পিস্তলটা ধরে প্রতিটি রুম সার্চ করে ও বাসার ।
নীচতলা আর দুইতলার কোন রুমেই কাওকে না দেখে স্বস্তি অনুভব করে ।
মনে পড়ে বেজমেন্টের কথা ।
বেজমেন্টে তেমন কিছু নেই । একটা বড় রেফ্রিজারেটর ছাড়া ।
শীতকালে মাসে একবারই বাজার করতেন নীরবের বাবা ।
এই শহরে শীতের তীব্রতা ভয়াবহ । কাজেই ফ্রিজার ভরে রাখলেই আর বার বার বাইরে যাওয়া লাগত না ।
পা টিপে টিপে বেজমেন্টে নেমে আসে নীরব । হাতে উদ্যত পিস্তল ।
বেজমেন্টটা ঘুটঘুটে অন্ধকার ।
দেওয়াল হাতড়ায় ও একহাতে ।
সুইচবোর্ডটা জানি কোথায় ?
বাবা-মার মৃত্যুর পর এখানে আসা হয় নি আর ।
সুইচ হাতে পেতেই উজ্জ্বল আলোয় ভরে যায় চারপাশটা ।
আৎকে ওঠে নীরব ।
না- বেজমেন্টে কেউ নেই, তবে তুষার শুভ্র দেওয়ালে কালচে হয়ে থাকা রক্তের ছাপটা ঠিকই চোখে পড়ে ওর ।
কাঁপা হাতে বিশাল ফ্রিজারটার ডালা খোলে ও ।
এক হাত কাটা ।
বুকে বিশাল একটা ফোকড় ।
চোখ দুটো বিস্ফোরিত রিনিতার ।
উদগত চিৎকারটা আর ঠেকিয়ে রাখতে পারে না নীরব ।
পরদিন সকাল ।
ফ্রিজ থেকে বের করে শুকনো নাস্তা খেয়ে কলেজের জন্য রেডী হয় নীরব ।
কাল সারা রাত ঘুমাতে পারে নি ও ।
বেজমেন্টে প্রিয় বান্ধবীর লাশ নিয়ে ঘুমানো যায় না ।
রিনিতার লাশটা এখনও ওখানে । ক্লাসে যেতে মোটেও মন চাচ্ছে না ওর ।
তবুও যাওয়া লাগবে ।
নাহলে সন্দেহের মাত্রা আরও বাড়বে ওর সহপাঠীদের মাঝে ।
অবশ্য ক্লাস হবে কি না সে নিয়েই সন্দেহ আছে অনেক । একই কলেজের দুই জন ছাত্র-ছাত্রী মারা যাওয়ার পর অভিভাবকেরা দাবী তুলতেই পারে খুনীকে পাওয়ার আগ পর্যন্ত কলেজ বন্ধ রাখার জন্য ।
শহরটা ছোট ।
তবে কেউ জানে না – খুনী বাইরের কেউ !
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাঁটে ও কলেজের দিকে ।
মোড়ের চায়ের দোকানে চোখ পড়তেই হৃৎপিন্ডটা গলার কাছে লাফ দিয়ে ওঠে ওর ।
সুমি ঢুকতেই বাইরে যে মানুষটাকে দেখেছিল – একই মানুষ বসে আছে চায়ের দোকানে !
কেন বসে আছে বলে দিতে হয় না ওকে । এখন নীরবকে পিছু নিয়ে ওকে ফাঁসানোর মত সিচুয়েশনে আরেকটা খুন করতে চলেছে ও নিশ্চয় !
মুখের ভাব পালটায় না নীরব ।
তবে বাসায় বাবার পিস্তলটা রেখে আসায় এই প্রথমবারের মত আফসোস হল ওর ।
ও চায়ের দোকান ছাড়িয়ে যেতেই মানুষটা ওর পিছু নেয় ।
টের পেলেও থামে না নীরব ।
এর শেষ দেখা দরকার । তবে পেছনে ফিরে তাকানো যাবে না
বুঝতে দেওয়া যাবে না নীরবও টের পেয়ে গেছে পুরো ঘটনা ।
তারপর সুযোগ বুঝে চেপে ধরতে হবে ওকে ।
কোনদিকে না তাকিয়ে সামনে হাঁটে নীরব ।
তবে খুব জোরে না – ও চায় না তৌফিক ওমর ওকে হারিয়ে ফেলুক ।
কলেজের গেইটে এসে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না – ঝট করে পিছনে তাকায় ।
কোথাও নেই তৌফিক ওমর ।
পরাজয়ের হতাশা চেপে ধরে ওকে ।
*
বাথরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন চোখেমুখে পানির ঝাপ্টা দেয় নীরব ।
গত একমাস ধরেই শারীরিক বা মানসিক শান্তি বলে কিছু নেই ওর মাঝে ।
প্রথমে বাবা-মার মৃত্যু – তারপর নিজের আত্মহত্যার প্রচেষ্টার ফলে তিনসপ্তাহ হাসপাতালে ।
সেখান থেকে বের হতে না হতেই কুটিল চাচার ষড়যন্ত্রের শিকার ।
মাতালের মত বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই ধাক্কা খেয়েছিল আরেকটু হলেই সুমির সাথে ।
পাশাপাশি দরজা ছেলেদের আর মেয়েদের বাথরুমের ।
‘সরি ।’ টকটকে লাল চোখ মেলে বলে নীরব ।
‘ঠিক আছে । ক্লাসে যাচ্ছ ?’ সুমির চোখও লাল । কান্নাকাটি করেছে অনেক – নিশ্চয় । হয়ত ও-ও গতকাল ঘুমাতে পারেনি ।
‘হুঁ । ক্লাসে যাই । অবশ্য আগে একবার অফিসে যাব । ক্লাসে দেখা হবে ।’ ওকে বলে সামনে হাঁটা দেয় নীরব ।
অফিসে একটা অ্যাপ্লিকেশন জমা দেয়ার কথা ওর ।
মেডিকেল সার্টফিকেট সহ – ওই তিনসপ্তাহ অ্যাবসেন্ট থাকায় যাতে কোন অসুবিধে না হয় সামনে – সেজন্য ।
অফিসরুমটা থেকে বেড়িয়ে আসতেই তীক্ষ্ণ চিৎকারে খান খান হয়ে যায় কলেজের ভাবগম্ভীর নীরবতা ।
মেয়েদের টয়লেট থেকে হিস্ট্রিয়াগ্রস্থের মত বেড়িয়ে আসে সাদিয়া ।
চেঁচিয়ে কলেজ তুলতে থাকা মেয়েটার মুখ থেকে কোন শব্দই বের করা যায় না ।
আশেপাশের শিক্ষকরা ওকে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করেন ।
হাসিনা ম্যাডাম বাথরুমে একবার উঁকি দিয়েই ছুটে ভেতরে ঢুকে যান ।
ভূত দেখে আসার মত চেহারা করে বেরিয়ে এসে বলেন কাঁপা কন্ঠে, ‘সুমির লাশ ভেতরে । কেউ গলা টিপে হত্যা করেছে ওকে । কল দ্য পুলিশ জাফর স্যার ।’
মাথায় বাজ পড়ে নীরবের ।
তবে আশেপাশের কোন কথা কানে যাচ্ছে না ওর তখন । অন্য কিছু ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ।
ভালোমানুষের মত মুখ করে কলেজ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ওর সৎ চাচা – তৌফিক ওমর ।
‘ইউ বাস্টার্ড !’ গলার রগ ছিড়ে চিৎকার দেয় নীরব, ‘ইউ ব্লাডি কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারার !’
তীর বেগে ছুটে যায় ও তৌফিক ওমরের দিকে ।
চারপাশ থেকে তাকিয়ে থাকা শিক্ষক-শিক্ষিকার অবাক দৃষ্টির দিকে ভ্রুক্ষেপও করে না ।
চিৎকার কানে গেছে ওমরেরও ।
ছুটতে শুরু করেছে সেও ।
বুলেটের মত কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে নীরব ।
তবুও চাচার চল্লিশ ফিট পেছনে ও ।
রাস্তার মানুষজনের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে নীরব – তবুও থামে না এক মুহূর্তও ।
ওর জীবন ধ্বংসকারী মানুষটিকে আজ পেয়ে গেছে হাতের মুঠোয় ।
বুনো মোষের মত ছুটতে থাকে ও ।
দশমিনিট ধরে ছোটার পরও চল্লিশ ফিটের দূরত্ব কমিয়ে কোনমতে বিশফিটে আনতে পেরেছে নীরব ।
বুকের ভেতরটা যেন ফেটে যাচ্ছে অর বাতাসে অভাবে ।
দুর্বিনীত, একরোখা চাচার শারীরিক গঠন ওর চেয়ে ভালো ।
এখনও অবিচল গতিতে ছুটে চলেছে মানুষটা ।
ছুটতে ছুটতে পার্কের কাছে চলে এসেছে ওরা ।
এখানেই সহপাঠী রিফাতকে নিষ্ঠুরের মত হত্যা করেছে লোকটা – ভাবতেই কোথা থেকে জানি আরও একটু শক্তি পায় নীরব ।
বাঘের মত পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও মানুষটার ওপর ।
দুইজনই গড়িয়ে পড়ে শক্ত মাটিতে ।
চেহারাটা এই প্রথমবার কাছ থেকে দেখতে পায় নীরব ।
সেই চোখ – সেই নাক – না, ও ভোলেনি ওর চাচাকে ।
মনের ঝাল মিটিয়ে দুটো ঘুষি মারে ও সৎ চাচার মুখে ।
তীব্র রাগে আত্মরক্ষার কথা ওর মাথাতেই ছিল না !
সেজন্য ছুটে আসা ঘুষিটা দেখতে পায় না ও – চোয়ালে আছড়ে পড়তেই তৌফিক ওমরের বুক থেকে উড়ে গিয়ে তিনফিট দূরে শক্ত জমিতে পড়ে ও ।
তারপর সব অন্ধকার ।
*
জ্ঞান ফিরে আসতেই নিজেকে সাদা বিছানায় আবিষ্কার করে নীরব ।
চারপাশে তাকিয়ে জায়গাটা চিনতে পারে ।
আগেও ও এখানে ছিল ।
ছোট্ট শহরটার একমাত্র হাসপাতাল ।
তবে এটা প্রাথমিক চিকিৎসা বিভাগ ।
পাশ থেকে হেসে ওর দিকে এগিয়ে আসে নার্স ।
‘জ্ঞান ফিরেছে, নীরব ?’ ওকে আগে থেকেই চেনে মহিলা । ‘তোমার ওপর ফাঁড়া আসতেই আছে । একা একা পার্কের ভেতর গেছ কি মনে করে ? ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলে মনে হয় ?’
‘হুঁ ।’ স্বীকার করে নেয় দ্রুত । আরও ঝামেলা বাড়াতে চায় কে ?
‘সাবধানে থেকো তুমি ।’ মমতাভরা কন্ঠে বলে নার্স, ‘তোমার জন্য আমাদের সবারই চিন্তা হয় । যা যাচ্ছে তোমার ওপর দিয়ে । আর শহরের মানুষও যেন কেমন ! এরপরেও তোমাকে নিয়ে আজেবাজে কথা ছড়ায় । আমি অবশ্য ওসব ছেঁদো কথায় কান দেই না । তোমাকে তো চিনি ।’
মহিলার প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করে ও । মা মারা যাওয়ার পর থেকে এই সুরে কেউ কথা বলে না ওর সাথে ।
আধঘন্টার মধ্যে ছাড়া পায় ও ।
বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে রাত হয়ে গেছে ।
মোবাইল বের করে সময় দেখতে গিয়েও পারে না – চার্জ নেই মোবাইলে ।
বন্ধ হয়ে আছে ।
কাঁধ ঝাঁকায় নীরব । বাসায় গিয়ে চার্জ দিয়ে নিলেই হবে ।
চোয়ালের ডানদিকে সুতীব্র একটা ব্যাথা এখনও আছে । ধাক্কাটা ভালোই লেগেছিল !
নিজেকে গালি দিতে দিতে বাসার দিকে হাঁটে ও ।
প্রায় পেয়েই গেছিল ও সব ঝামেলার মূল হোতাকে ।
রাগের ঠেলায় সব ভন্ডুল করে না ফেললে এতক্ষণে ওকে নিয়ে পুলিশ কাস্টডিতে রেখে আসতে পারত ।
সে জায়গায় নিজেরই ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালে !
পুলিশের কাস্টডিতেও চলে যেতে পারে কাল সকাল নাগাদ ।
এক ঘর ভর্তি টীচারের সামনে দৌড়ে পালিয়েছে ও আজ ; ঠিক যখন সুমির মৃত্যুর কথা উচ্চারণ করেন ম্যাডাম তখনই ।
অন্তত সবার চোখে এমনই লাগার কথা ব্যাপারটা ।
বাসায় ফিরে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে নিজেকে নিরাপদ মনে হয় কিছুটা ।
এখনও ঠিক করেনি রিনিতার ডেডবডি নিয়ে কি করবে – হালকা অস্বস্তি হচ্ছে ওর ।
গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে এক কাপ কফি বানায় ।
আগে ও বাইরে থেকে আসলেই মা বানিয়ে দিতেন ।
ভেতরে ভেতরে তীব্র ঘৃণায় ছেয়ে যায় ওর অন্তর । তৌফিক ওমরকে এর পরের বার পেলে আর কিছুতেই ছাড়বে না – মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ও ।
ওমরের কথা মনে পড়তেই ড্রেসারের ড্রয়ার খোলে দ্রুত ।
সাথে পিস্তলটা রাখা দরকার এই সময়গুলোতে ।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ও সেদিকে ।
পিস্তলটা নেই ।
ছুটে গিয়ে পেছনের দরজাটায় চলে আসে নীরব ।
কার্ডবোর্ডের টুকরোটা কেউ জোর খাটিয়ে ছুটিয়ে ফেলেছে ।
মোবাইলে চার্জ নেই – তবে দোতলায় বাবা-মার ঘরে ফোনটা আছে ।
বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে । তার মাঝেই ছুটতে ছুটতে দোতলায় ওঠে ও ।
বাবা-মার ঘরে পৌঁছতেই স্থির হয়ে যায় ও ।
বিশাল খাটটার শেষ প্রান্তে বসে আছে তৌফিক ওমর ।
পিস্তলটা সরাসরি ওর বুকের দিকে তাক করা ।
‘বসে পড় ।’ সামনের খালি চেয়ারটা দেখায় লোকটা, ‘কথা আছে ।’
‘তৌফিক ওমর !’ রাগে হিস হিস করে নীরব ।
‘বাহ বাহ !’ খুশি হয়ে ওঠে লোকটা, ‘আমাকে মনে আছে দেখছি !’
‘আমার জীবন ধ্বংসকারী মানুষটাকে ভুলে যাব তা ভাবলেন কি করে ?’ কড়া গলায় বলে নীরব ।
হতাশায় মাথা নাড়ে ওমর, ‘তোমার জীবন রক্ষা করতেই চেয়েছিলাম । সেটাকে জীবন ধ্বংস করা ভাবলে আমি আসলেই দুঃখ পাব । তাছাড়া চেহারা মনে রাখলেও নাম মনে রাখবে – এতদূর ভাবি নি । তোমার বয়স যখন পাঁচ বছর – তখন তোমার সাথে শেষ দেখা আমার ।’
‘এতদিন পরে দেখা করতে এসেছেন নিজের স্বার্থে । নয় কি ?’ হুংকার দিয়ে বলে নীরব ।
কিছু একটা বলে চায় তৌফিক ওমর । তবে তাকে সেই সুযোগ দেয় না নীরব ।
‘থামুন ! আমাকে বলতে দিন ! বিদেশে ঘুরে ঘুরে নিজের সর্বস্ব খুঁইয়েছেন । এরপর এসেছেন সৎ ভাইয়ের সম্পত্তি নিজের করে নিতে । সেদিন রাতে কি হয়েছিল আমি জানি না । কিভাবে কাজটা করেছেন সেটাও আমি জানি না । তবে গাড়ি চালানোতে ভালোই দক্ষ ছিলেন আমার বাবা । এভাবে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করার মত মানুষ তিনি ছিলেন না । তারপর লেগেছেন আমার পিছে । আমারই সহপাঠীদের খুন করেছেন এমন ভাবে যাতে মনে হয় খুনগুলো আমার করা । সাবাশ, মি. তৌফিক ওমর ! চমৎকার আপনার প্ল্যান ! ’
‘আমার আর তোমার বাবার সম্পর্ক কি ছিল বলে মনে করছ ? ’ রীতিমত অবাক হয়ে বলে তৌফিক ওমর ।
‘খুবই মধুর সম্পর্ক !’ হিস হিস করে বলে নীরব । ‘সৎ ভাইয়ের প্রতি কেমন সম্পর্ক থাকতে পারে ওটা আমাকে বলে দিতে হবে কষ্ট করে ?’
‘তুমি ভুল করছ, নীরব ।’ প্রতিটা শব্দ থেমে থেমে উচ্চারণ করে ওমর । ‘আমি তোমার বাবার সৎ ভাই নই । যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল ফয়সাল আহমেদ । তিনি মারা গেছেন যখন তোমার বয়স পাঁচ । ’
বিস্ময়ের ধাক্কাটা এতটাই আকস্মিক – কথা হারায় নীরব ।
‘কাগজ কাটার ছুরি দিয়ে তোমার সৎ চাচাকে তুমি জবাই করেছিলে, নীরব ।’ আস্তে করে বলে ওমর । ‘আর ওখানেই আমার দৃশ্যপটে আগমন । আমি তখন ছিলাম তিরিশ বছরের তরুণ সাইকিয়াট্রিস্ট । তোমার বাবার ছোটবেলার বন্ধু । কি করবেন বুঝে না উঠে আমার শরণাপন্ন হন তিনি । যথাসম্ভব ট্রিটমেন্ট দেই আমি তোমার । বিভিন্ন বয়েসে তোমার চাচার ব্যাপারে বিভিন্ন আপডেট দিতে বলি তোমার বাবাকে । তুমি ঘটনাটা ভুলে গেছিলে – সেই সাথে বিভিন্ন সময় সৎ চাচার বিভিন্ন স্থানে থাকার কথা শুনে আপডেট পেয়ে চাচাটি তোমার কাছে জীবিত কেউ হয়ে বেঁচে রইল । তবে ভয়ে ছিলাম তোমার বয়ঃসন্ধিকাল পেরিয়ে গেলেই পাগলামী আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে তোমার ।’
নিজের মানিব্যাগ ছুঁড়ে দেন তিনি ।
বাতাসে লুফে নেয় নীরব ।
একটা ছবিতে দুই বন্ধু গলাগলি করে দাঁড়িয়ে আছেন – তৌফিক ওমর আর নীরবের বাবা ।
আর একটা আইডি কার্ড । মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তৌফিক আলমের । ছবিটাও মিলে যায় ।
সামনে তাকায় নীরব । চোখে শূন্য দৃষ্টি ।
‘তাহলে আমার বাবা মা ?’
‘তুমি সেরাতে ছিলে ওদের সাথে গাড়িতে ।’ আগের মতই মাপা মাপা কন্ঠে বলে চলেন তৌফিক ওমর । ‘এখানে আসার আগ পর্যন্ত বুঝিনি তোমার বাবার মৃত্যু রহস্য । আমি খবরটা শুনে চলে আসি – তোমার পাশে কারও দাঁড়ানোর দরকার মনে করে । তবে এসে শুনি তুমি হাসপাতালে । তোমাদের বাসায় গেছিলাম যখন শুনি তুমি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছ । মনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ জেগেছিল শুনেই ।’
একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বাড়িয়ে দেন তিনি নীরবের দিকে ।
‘এটা পড়ে ছিল তোমাদের বাগানে । কেন ? বাগানে স্ক্রু-ড্রাইভার থাকবে কেন ?’ প্রশ্ন করলেও উত্তরটা তিনি জানেন, বোঝাই গেল, ‘কারণ – সেরাতে গাড়িতে তুমি ওদের সাথে ছিলে । স্ক্রুড্রাইভারটা হাতে মুচড়াচ্ছিলে । হঠাৎ কি যেন হয় তোমার । বাবার ঘাড়ে সম্পূর্ণ স্ক্রু-ড্রাইভারটা ঢুকিয়ে দাও তুমি, নীরব ।’
শুনে থর থর করে কেঁপে ওঠে নীরব । সব মনে পড়ে গেছে ওর সেরাতের কথা । তবে বলে চলেন তৌফিক ওমর ।
‘তারপর দরজা খুলে ঝাঁপ দাও বাইরে । রাস্তায় প্রচন্ড ভাবে ঠুকে যায় তোমার মাথা । এবং গাড়িটা ছুটে যায় খাদের দিকে । তুমি ঠিকই বলেছ নীরব । তোমার বাবাকে আমি প্রায় সারাজীবন ধরে চিনি । এভাবে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করার মত মানুষ তিনি ছিলেন না । ’
নীরব মুখ খুলে কাঁপা কন্ঠে, ‘তাহলে ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার কথা কেন -’
‘কেন বলল এলাকার সবাই ? তুমি ফেটে যাওয়া মাথা নিয়েই হেঁটে ফিরে এসেছিলে শহরে । বাসা যখন তোমার দৃষ্টি সীমার ভেতর – তখন তোমাকে ফোন করে জানানো হয় তোমার বাবা-মার দুর্ঘটনার কথা । কোনমতে বাগান পর্যন্ত পৌঁছে জ্ঞান হারাও তুমি ।’
‘রিনিতা -’
‘আমি ফলো করছিলাম তোমাকে, নীরব । যাতে আর কোন অঘটন না ঘটাতে পারো । শুক্রবার ব্লাড প্রেশার লো হয়ে যাওয়ার পরও দ্রুত রিকভার করো তুমি । ডাক্তারের শিফটীং টাইম বেছে নিয়ে মেসেজ দাও রিনিতাকে । বাসার দিকে ছুটে আসে রিনিতা । - এটা অবশ্য আমার গেস । কারণ মেসেজ তুমি না পাঠালে ওর আসার টাইমিং নিখুঁত থাকত না ।’
ভুল কিছু বলেন নি ড. তৌফিক ওমর – স্পষ্ট বুঝতে পারে নীরব । সব মনে যাচ্ছে ওর এই ঘটনাটাও ।
‘আমি তোমাকে হাসপাতাল থেকে বের হতে দেখি । দ্রুত ফিরে আসি তোমার বাসায় । কিন্তু রিনিতাকে আসতে দেখলেও তোমায় আসতে দেখি না । নিশ্চয় পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছিলে । প্রায় আধঘন্টা খুঁজে পেছনের দরজার কাঁচটা ভাঙ্গা পাই । যতক্ষণে আমি বেজমেন্টে রিনিতার লাশ আবিষ্কার করি তুমি বেরিয়ে গেছ আবার হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ।’
‘আর রিফাতের ব্যাপারটা -’
‘সহজ । পুলিশ স্টেশন থেকে ফিরে আসার সময় তোমাকে মিস করি । নিশ্চয় পার্ক দিয়ে নেমে গেছিলে । পথে পেয়ে যাওয়া পরিচিত মুখ রিফাতকে । ওখানেই শেষ করে দিয়েছ বেচারাকে ।’
‘সুমিকে আমি ওর পেছন থেকে গলা চেপে ধরি - ’ মনে পড়তে ফুঁপিয়ে ওঠে নীরব । ‘ও আমাকে সরাতে চেষ্টা করেছিল অনেক – কিন্তু -’
‘তোমাকে আমি সাহায্য করতে চাই, নীরব ।’ ধীরে ধীরে আবার বলেন ড. তৌফিক ওমর, ‘তোমার ভেতর একসাথে কয়েকটী মানসিক সমস্যা দেখা যায় । খুবই রেয়ার কেইস । অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসর্ডার যেটাকে আমরা OCD বলি – এর তীব্রতম ইফেক্ট হল শর্ট টাইম মেমরি লুজিং । ভায়োলেন্ট হয়ে যাও তুমি অল্প সময়ের জন্য – তবে ভায়োলেন্ট অবস্থা কেটে গেলে তখন আর মনে থাকে না কিছু । আমি তোমাকে এখনও সাহায্য করতে পারি – নীরব । কাম উইদ মি ।’
শূন্য চোখে তাঁর দিকে তাকায় নীরব ।
আস্তে করে মাথা নাড়ায় দুই পাশে ।
ঠিক এক মুহূর্ত আগে তৌফিক ওমর বুঝে ফেলেন কি ঘটতে যাচ্ছে !
‘নো!’ চেঁচিয়ে উঠেন তিনি ।
দেরী হয়ে গেছে ততক্ষণে ।
পুরো স্ক্রু-ড্রাইভারটা নিজের গলায় গাঁথিয়ে দিয়েছে নীরব ।
পিচকিরির মত রক্ত বেরিয়ে আসে ক্ষতস্থান থেকে – ভিজিয়ে দেয় সামনে বসা ওমরের চোখ মুখ ।
অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন সাইকিয়াট্রিস্ট – ছেলেটাকে বাঁচানো এখন আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয় ।
চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে যাচ্ছে নীরব ছেলেটা ।
আর্দ্র চোখে তাকিয়ে দেখেন শুধু তিনি ।