- এই শুভ্র, এই!
প্রৌঢ় ভদ্রমহিলা জানালা দিয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকেন।
- জী আন্টি?
ছেলেটা ডাক শুনতে পেয়েছে।
- কোথায় যাও এই ভরদুপুরে?
- স্কুল মাঠে, খেলা আছে।
- এই ভরদুপুরে খেলা! ক’টা বাজে এখন?
- কী করব বল! আগামীকাল ‘ইলুমিনেটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে', অনির্বাণ সঙ্ঘের সাথে ফাইনাল খেলা। ওরা অনেক ভাল খেলে। গতবার ওদের কাছে ফাইনালে হেরে গেছিলাম, এইবার জিততেই হবে। তাই আমাদের ক্যাপ্টেন আজ সবাইকে ভালভাবে প্র্যাকটিস করতে বলেছে। যেতেই হবে!
- বাবা জানলে বকবে না?
- বাবা ঘুমাচ্ছে, জানতে পারবে না। মাকে ম্যানেজ করে এসেছি যেন না বলে। জিজ্ঞেস করলে যেন বলে কোচিং-এ গেছি!
- তুমি তো ভীষণ দুষ্টু হয়ে গেছ! পড়ালেখা বাদ দিয়ে খেলতে যাচ্ছ, আবার পড়া নিয়ে মিথ্যা বলছ!
কিছুটা বকুনির সুরে কথাগুলো বললেন মিসেস সিদ্দীকা।
- এই বয়সে যদি দুষ্টুমি না করি, তবে করব কখন!
দুষ্টুমিমাখা একটা হাসি দিয়ে কথাগুলো বলল শুভ্র।
- আচ্ছা আন্টি, দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি গেলাম!
ছেলেটা এবারে ব্যস্ত হল।
- ঠিক আছে যাও। সন্ধ্যায় একবার বাসায় এসো। তোমার জন্য কিছু পাকা পেয়ারা পাড়িয়ে রেখেছি, নিয়ে যেও।
- আচ্ছা!
শুভ্র ব্যাট হাতে বল পিটানোর ভঙ্গী করতে করতে চলে যাচ্ছে। মিসেস সিদ্দীকা ছেলেটার যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে আছেন।
এই ছেলেটাকে তিনি খুব পছন্দ করেন। রক্তের কোন সম্পর্ক ওর সাথে নেই ঠিকই, তবে যে সম্পর্ক আছে তা রক্তের সম্পর্কের চেয়ে কম নয়।
শুভ্র ক্লাস সেভেনে পড়ে। খুব দুরন্ত আর ডানপিটে। তার ছেলেটাও ওর বয়সে এমনই ছিল। চেহারায় খানিকটা মিলও আছে দু'জনার। ওকে দেখলে নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে যায়। হয়ত এ কারণেই ছেলেটাকে এত পছন্দ করেন তিনি।
শুভ মিসেস সিদ্দীকার একমাত্র ছেলে। এখন ইউএসএ-তে থাকে। ও ছোট থাকতেই ওর বাবার সাথে তার ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর ওর বাবা ব্যবসাসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। কয়েক বছর পর ছেলেকে বিদেশে পড়ালেখার জন্য নিজের কাছে নিয়ে যেতে চান। মিসেস সিদ্দীকা এতে বাঁধা দেন নি। ছেলে ভালভাবে পড়ালেখা করে মানুষের মত নানুষ হোক, এটা তিনিও চান।
ছেলেটা যেদিন ওকে ছেড়ে চলে গেল, তার কাছে মনে হল কেউ যেন তার কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে গেল। বিরাট বাড়ির বিশাল নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে তিনি একাই থাকেন। ছেলের চিন্তায় চিন্তায় অল্প ক’দিনের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ছেলে তখন সবেমাত্র একটা কলেজে ভর্তি হয়েছে। মায়ের অসুস্থতার খবর জানলে সব ফেলে চলে আসবে। ছেলের পড়াশোনায় ব্যাঘাত তিনি ঘটাতে চান নি। তাই ছেলেকে তিনি কিছু জানালেন না। গ্রাম থেকে একটা ছেলেকে নিজের কাছে আনিয়ে রাখলেন। সে-ই বাসার টুকটাক কাজ করে দেয়। মিসেস সিদ্দীকা স্মৃতির এলবাম খুলে বসে দিনের পর দিন ছেলের কথা ভাবতে থাকেন। আশায় আশায় পথের দিকে চেয়ে বসে থাকেন তিনি, ছেলে তার কবে আসবে। পড়াশোনার ব্যস্ততায় ছেলের আর আসা হয়ে ওঠে না।
একদিন দুপুরবেলা ভেতর ঘরে শুয়ে মিসেস সিদ্দীকা ফটো অ্যালবামে শুভর ছবি দেখছিলেন, আর ভাবছিলেন- না জানি মাকে ছাড়া ছেলেটা তার কেমন আছে!
ফটো দেখতে দেখতে ঘুমে চোখ ভারী হয়ে এসেছিল; তন্দ্রা কেটে গেল জোর আওয়াজে। হঠাৎ বাড়ির পিছন দিকটায় গোয়ালঘরের টিনের চালে দুমদাম শব্দ। ঘরে তখন তিনি একাই ছিলেন। কাজের ছেলেটা বারান্দায় ঘুমাচ্ছে।
কী শক্ত ঘুম রে বাবা! কাছেই এত জোরে শব্দ হল, অথচ সে টেরই পেল না! মিসেস সিদ্দীকা কিছুটা বিরক্ত হলেন। কিন্তু ছেলেটার ঘুম ভাঙাতে তার ইচ্ছা হল না। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি নিজেই বাইরে এলেন।
গোয়ালঘরের পাশে বড় একটা পেয়ারা গাছ। গাছে এবার ঝাঁকিয়ে পেয়ারা ধরেছে। বারো-তের বছরের একটা ছেলে কয়েকটা পেয়ারা নিয়ে তড়িঘড়ি করে গাছ থেকে নামছে। তার হাফপ্যান্টের দুই পকেটে আর হাতে কয়েকটা পেয়ারা, এগুলোর মধ্যে একটা হাত থেকে টিনের চালে পড়ে গিয়েছিল।
ছেলেটা মিসেস সিদ্দীকাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে, না ঝেড়ে দৌড় মারবে- ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মিসেস সিদ্দীকা একটুও রাগ করলেন না। ছেলেটাকে আদর করে কাছে ডাকলেন। ছেলেটার সাহস হল না সামনে আসার, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মিসেস সিদ্দীকা ছেলেটাকে অভয় দিলেন। ছেলেটা এবার এক পা, দু পা করে সামনে আসলো।
- কী নাম তোমার, বাবা?
- শুভ্র!
ছেলেটা এক কথায় জবাব দিল।
- বাহ্, ভারী মিষ্টি নাম! তোমাদের বাসা কোথায়?
- উত্তরপাড়ায়। এই নাও সব পেয়ারা, আমি আর কখনো তোমার গাছ থেকে পেয়ারা পাড়ব না। তুমি আমার বাবাকে বলে দিও না, প্লিজ!
- ঠিক আছে, বলব না। কিন্তু তুমি এই ভরদুপুরে গাছে উঠেছ কেন? জানো না দুপুরবেলা গাছে উঠতে নেই?
- কেন, দুপুরবেলায় গাছে উঠলে কী হয়?
ছেলেটা সহজ হতে শুরু করেছে।
- ভূতে ধরে!
মিসেস সিদ্দীকা ইতঃস্তত করে বললেন। ছোটবেলায় মুরুব্বিদের মুখে শুনেছিল। শুভ্রর চোখেমুখে উদ্বেগ দেখে তিনি এবার হেসে ফেললেন।
- মজা করলাম! শোনো, আমার বাগানে অনেক রকম ফল গাছ আছে। তোমার যখন যে ফল খেতে মন চাইবে আমাকে বলবে, আমি পাড়িয়ে দেব। নিজে গাছে উঠবে না, পড়ে গেলে ব্যাথা পাবে। ঠিক আছে?
শুভ্র মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। মিসেস সিদ্দীকা একটা প্যাকেটে করে পেয়ারাগুলো শুভ্রর হাতে দিলেন। চুলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার আসতে বললেন।
ছেলেটা প্রায়ই আসত। অল্প ক’দিনেই খুব খাতির হয়ে গেল দুজনার। রাজ্যের সব গল্প ছেলেটার। আজ কী করেছে সে, কোথায় কী ঘটেছে, এইসব আর কি! ও যতক্ষণ থাকত ছেলের অভাব ভুলে থাকতেন তিনি। এভাবে ভালোই দিন কাটছিল।
বেশ ক’দিন হয়ে গেল ছেলেটা আসে নি। এর মধ্যে শুভ একদিন হঠাৎ এসে হাজির। মাস খানেক কলেজ বন্ধ থাকবে। না জানিয়ে হঠাৎ দেশে এসে সে মাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছি। কিন্তু বাড়ি এসে সে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেল। মায়ের এ অবস্থা দেখে খুব কষ্ট পেল। মা ওকে সান্ত্বনা দেন। কিন্তু সে মানতে নারাজ। মাকে সে এবার নিজের কাছে নিয়েই যাবে। মিসেস সিদ্দীকা অনেক গড়িমসি করে অবশেষে সম্মতি দিলেন।
কিন্তু এবার যাওয়া হল না তার। ভিসা পাওয়া গেল না। ঠিক হল শুভ সামনের বার সব কিছু ঠিক করে তবেই আসবে।
শুভর যাওয়ার সময় হয়ে এলো। রাত দশটায় ফ্লাইট। ও বিকেল বেলা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। মা অনেক কষ্টে তাকে বিদায় দিলেন। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। পরদিন মন ভাল হয়ে গেল। শুভ্র এসেছে!
- কী ব্যাপার, কোথায় ছিলে এতদিন? একবারও যে বাসায় এলে না!
- গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম
- কোই, গ্রামে যাবে, আগে তো বল নি।
- হঠাৎ করে দাদাজান অসুস্থ হয়ে পড়লেন তো, তাড়াহুড়ো করে যেতে হলো। তাই তোমাকে জানানোর সময় পাই নি
- জানো, তুমি যাওয়ার পরদিন আমার ছেলেটাও এসে হাজির! গতকাল আবার বিদেশে চলে গেছে।
- ভাইয়া চলে গেছে, তোমার মন খারাপ, না?
- হুম। তবে ও বলেছে আমাকে ওর কাছে নিয়ে যাবে।
- কবে?
চোখমুখ কিছুটা শক্ত হয়ে উঠেছে শুভ্রর।
- এই তো, ভিসা পাওয়া গেলেই!
দুজনেই চুপচাপ হয়ে গেল।
মাস খানেকের মধ্যে ভিসা পাওয়া গেল। শুভ নিজে দেশে এসে মাকে নিয়ে গেল। অসুস্থ মাকে অন্য কারও কাছে ছাড়তে নারাজ সে।
গত তিনদিন ছেলেটা আসে নি। মিসেস সিদ্দীকা ওর জন্য বাগান থেকে বেছে বেছে পাকা দেখে কিছু ফল পাড়িয়ে রেখেছেন। সুন্দর একটা ক্রিকেট ব্যাট আর ফুটবল কিনে রেখেছেন। ছেলেকে দিয়ে বিদেশ থেকে সুন্দর কিছু গিফট্ আইটেম আনিয়েছেন। ওর পছন্দের কিছু খাবার- আচার, নাড়ু, পিঠা, মোরব্বা বানিয়ে রেখেছেন। বিদেশে যাওয়ার আগে শুভ্রকে তিনি এগুলো দেবেন।
কিন্তু ছেলেটা এলো না। আশপাশে, উত্তরপাড়ায় অনেক খুঁজেও তার সন্ধান পাওয়া গেল না। একটা জলজ্যান্ত মানুষকে এভাবে বেমালুম লাপাত্তা হতে দেখে তিনি খুব অবাক হলেন। ওর সাথে দেখা না করেই তাকে চলে যেতে হল। মনে একটা অতৃপ্তি রয়ে গেল তার।
নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী ছেলেটার জন্য তিনি মনের গভীর থেকে টান অনুভব করেন। যখনই তিনি ছেলের অভাব বোধ করেছেন এই ছেলেটা সে অভাব পূরণ করে দিয়েছে, চাই সে হোক এই বাস্তব দুনিয়ার কেউ, কিংবা তার মনের নিছক কল্পনা।